সাগর দৈত্যদের খোঁজ এবং তাদের ভবিষ্যৎ
জাহাজ মালিকেরা মহাসাগরে ভাসানো অসাধারণ সব জাহাজ নির্মাণ নিয়ে দুনিয়াজুড়েই প্রতিযোগিতা করছেন৷ এই দৌড়ে আকার-আকৃতিই একমাত্র বিষয় নয়৷ প্রযুক্তিও এখানে বিবেচ্য৷
আকৃতিতে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং
হামবুর্গ পোতাশ্রয়ে যাওয়া সর্ব বৃহৎ জাহাজের রেকর্ড গড়তে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ মালবাহী জাহাজ এলবে নদী পাড়ি দিয়েছে৷ ৪০০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই জাহাজটি সাধারণত ২০ হাজার ১৭০টি কন্টেইনার বহন করে৷ তবে গভীরতা কম হওয়ায় এই নদী পাড়ি দেয়ার সময় কন্টেইনার কমাতে হয়েছে৷ জাপানের শিপিং ফার্ম মিটসুই ও.এস.কে. এই জাহাজকে ইউরোপ-পূর্ব এশিয়া রুটে নিয়মিতভাবে চালাতে চাচ্ছে৷
অন্তহীন প্রতিযোগিতা
‘ওওসিএল হংকং’ নামে একটি জাহাজ শীঘ্রই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কন্টেইনার শিপ মাদ্রিদ মায়ের্স্ক-এর পাশাপাশি এমওএল ট্রায়াম্ফকে ছাড়িয়ে যাবে৷ কারণ, নতুন দৈত্যাকার এই জাহাজটি ২১ হাজার কন্টেইনার বহন করতে পারে৷ সিকি শতাব্দী পূর্বে বৃহৎ মালবাহী জাহাজ ৪ হাজারের কিছু বেশি কন্টেইনার বহন করতে পারতো৷
এত বড় যে সামলানোই কষ্ট
৪৫৮ মিটার দৈর্ঘ্যের নরওয়ের তেলবাহী জাহাজ ‘জাহরে ভাইকিং-’ই এ পর্যন্ত নির্মিত সর্ব বৃহৎ জাহাজ৷ থামতে হলে জাহাজটির ৬ কি.মি. জায়গা দরকার হতো৷ পানামা খাল, সুয়েজ খাল, ইংলিশ চ্যানেলে এটা চলতেই পারতো না৷ ২০০৪ থেকে ২০০৯ সালের মাঝের সময় এটা ভাসমান তেল সংরক্ষণাগার হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে৷ পরে এটি গুজরাটের জাহাজ ভাঙা শিল্পে বেচে দেয়া হয়৷
পানিতে ছোট্ট শহর
৩৬২ মিটার দৈর্ঘ্যের ‘দি হারমোনি অব দ্য সি’জ’ হচ্ছে সর্ববৃহৎ প্রমোদ তরী৷ ৬ হাজার ৩০০’র বেশি যাত্রী এই জাহাজে সময় উপভোগ করতে পারেন৷ এ প্রমোদ তরীতে কাজ করছেন ২১০০ ক্রু৷ এতে ১৬টি ডেক, ২০টি ডাইনিং রুম, ২৩টি সুইমিং পুল, সর্ব বৃহৎ ‘ওয়াটার স্লাইড’ এবং ১২ হাজার গাছ রয়েছে৷ এই জাহাজের জন্য রয়েল ক্যারিবিয়ান ক্রুজকে ১ বিলিয়নেরও বেশি ব্যয় করতে হয়েছে৷
অতি বড়লোকের ‘খেলনা’
জাহাজ মালিকদের মাঝে সবচেয়ে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ‘সুপার ইয়ট’ ক্যাটাগরিতে৷ আরব শেখ, সোভিয়েত যুগের সম্পদ হাত করা রাশিয়ান টাকাওয়ালা, মার্কিন বিলিয়নিয়াররা এই প্রতিযোগিতা করে৷ বিলাসিতার দৌড়ে অপরকে পেছনে ফেলতে নির্মাণ চলাকালে খরচ বাড়িয়ে দিতেও তারা কুণ্ঠা করে না৷ এক সৌদি শেখের ১৮০ মিটার লম্বা একটি ইয়ট রয়েছে, যাতে বিমান নামার জায়গা রয়েছে৷ রয়েছে মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং সাবমেরিন৷
রোম্যানটিকদের ভ্রমণ-জাহাজ
সাগর-যাত্রায় থাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইয়টকে ‘সেইলিং ইয়ট এ’ বলা হয়৷ ডিজাইনার ফিলিপ স্টার্ক এটা বানিয়েছেন৷ রাশিয়ান বিলিয়নিয়ার আন্দ্রে মেলনিশেঙ্কো এটার মালিক৷ ৩ হাজার ৭৪৭ বর্গমিটার জায়গা নেয়া এই ইয়টটি একটি ফুটবল মাঠের অর্ধেক৷ এটার আটটি ডেক, তিনটি সুইমিংপুল এবং জাহাজের তলদেশের নীচে একটি ডুবো পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে৷
সবচেয়ে বেশি খরচে যুদ্ধ জাহাজ
প্রধান জাহাজ হিসাবে এ বছরের এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-বহরে ‘দি জেরাল্ড আর ফোর্ড’ যুক্ত হয়েছে৷ এর জন্য মার্কিন সামরিক বাহিনীকে ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছে৷ বাষ্পচালিত পদ্ধতির পরিবর্তে তড়িৎ-চুম্বকীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে এই জাহাজ আরও দক্ষতার সাথে এবং দ্রুত গতিতে যুদ্ধবিমানকে ধাবিত করতে পারবে৷
যেখানে দিশারী রাশিয়া
তিন মিটার পুরু সুমেরু’র বরফখণ্ড৷ রাশিয়ার আনবিক শক্তি সম্পন্ন বরফভাঙা-আর্কটিকার জন্য এটা কোনো ব্যাপারই না৷ দেশটির গণমাধ্যম বলছে, নিজস্ব ধরণে এটা সবচেয়ে শক্তিশালী জাহাজ, যা এ বছরের শেষের দিকে কাজে নামবে৷ তারপর এটাকে সুমেরুর তেল ও গ্যাসক্ষেত্রে মোতায়েন করা হবে৷ যার কাজ হবে রাশিয়ান ট্যাঙ্কারগুলো আটকে গেলে ছাড়িয়ে দেয়া৷ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশটি এ ধরণের আরও বেশ কয়েকটি জাহাজ বানাতে চায়৷
শিথিল পেশীর মানুষ
‘থিয়াল্ফ’ সম্ভবত এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নির্মাণ-জাহাজ৷ উপকূলের কাছাকাছি জায়গায় নির্মাণে এটা ১৪ হাজার টনের ভার বহন করতে পারে৷ কাজের জন্য এটা ৮৭ ফিট নীচে স্থির হতে পারে৷ এটা খুব শক্তিশালী হলেও গতি খুবই কম৷ এটা কেবল ঘণ্টায় ১১ কি. মি. চলতে পারে৷
বৃহত্তম পরিবহণ জাহাজ
ভাসমান তেলের রিগ বা একটা পূর্ণ জাহাজও নিয়ম মেনে নাড়ানো যায়৷ শক্তিশালী এই জাহাজ সাগরে ডুব দেয়, মাল নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসে৷ এরপর জাহাজ নিজেকেই তুলে আনে৷ পৃথিবীর বৃহত্তম পরিবহণ জাহাজটির দৈর্ঘ্য ২৭৫ মিটার৷
পানিতলে অচিন দেশে
ক্যানাডিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক জেমস ক্যামেরন ‘চ্যালেঞ্জার ডিপ’ নামে পরিচিত ‘ডিপসি চ্যালেঞ্জার’ দিয়ে সবচেয়ে গভীর জলে ডুব দেন৷ যেটা প্রশান্ত মহাসাগরে ১০ হাজার ৯৮৪ মিটার গভীরে অবস্থিত৷ ২০০৫ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে গোপনে অস্ট্রেলিয়ায় সাবমেরিন তৈরি করা হয়৷ একটি বদ্ধঘর হলেও যাত্রীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ, তারা ১০৬ মিটার ব্যাসের একটি শক্তিশালী স্টিল বলে বসেন৷
যেখানে মানুষই অপ্রয়োজনীয়
আকৃতিই সবকিছু নয়৷ ভবিষ্যতের জাহাজ বিজলী চালিত হবে৷ থাকবে না কোনো ক্রু৷ আগামী বছর নরওয়ে প্রথম স্ব-চালিত ই-কন্টেইনার জাহাজের প্রথম পরীক্ষা করতে যাচ্ছে৷ ‘ইয়ারা বের্কেল্যান্ড’ নরওয়ের উপকূল বরাবর সার পরিবহণ করবে৷ এটাতে অবশ্য একজন ক্যাপ্টেন থাকবে৷ ২০১৯ সাল থেকে এটি রিমোট টিপে চালানো হবে৷ ২০২০ সাল থেকে এটি নিজে নিজেই চলবে৷