1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সরকার বা সাধারণ মানুষ, কেউই দায়িত্ব পালন করেনি

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি
২১ আগস্ট ২০২০

করোনা ঠেকাতে মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে দীর্ঘ লকডাউন ঘোষণা করেছিল ভারতে। সব বন্ধ। তারপর যখন প্রায় সব খুলে দেয়া হলো তখন হু হু করে করোনা বাড়ছে। লোকের চাকরি নেই। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাহলে সরকারি সিদ্ধান্তে লাভ কী হলো?

https://p.dw.com/p/3hHye
ছবি: DW/A. Ansari

ভারতে করোনার প্রবেশ গত ৩০ জানুয়ারি, উহান ফেরত কেরালার একজনের হাত ধরে। সেই শুরু। তারপরের কাহিনি ভয়, আতঙ্ক, করোনার দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এবং সরকারের একের পর এক তড়িঘড়ি করে নেয়া সিদ্ধান্তের, যার পিছনে চিন্তাভাবনার ছাপের থেকে অনেক ক্ষেত্রেই আতঙ্ক বেশি কাজ করেছে।

জানুয়ারির শেষে করোনার প্রবেশের পর পুরো ফেব্রুয়ারি মাস কেটেছে। মার্চের অনেকখানি চলে গেছে। হঠাৎ, ২২ মার্চ ১৪ ঘণ্টার জন্য জনতা কার্ফুর ডাক দিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তার একদিন পর থেকে শুরু হলো লকডাউন। রাত আটটার সময় প্রধানমন্ত্রী জানালেন রাত বারোটা থেকে লকডাউন শুরু হয়ে যাবে পুরো দেশে। ২১ দিনের জন্য বন্ধ পুরো দেশ। ২১ দিন পর দুই সপ্তাহ করে দুই বার লকডাউন বাড়ানো হলো। প্রধানমন্ত্রী মোদী লকডাউন ঘোষণা করার সময় বলেছিলেন, ২১ দিনে করোনার চেইন ভাঙা সম্ভব হবে। ২১ দিন লকডাউন পালন না করলে দেশ ২১ বছর পিছিয়ে যাবে। পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে।

প্রশ্নটা হলো, পুরো ফেব্রুয়ারি মাস এবং মার্চের প্রথম ২১ দিন সরকার কী করছিল? ততদিনে চীন, ইউরোপের দেশগুলিতে করোনার প্রসার দেখে ফেলেছে পুরো বিশ্ব। ভারত এটাও দেখেছে, করোনা আসছে বিদেশ থেকে। প্রথমে চীন থেকে এসেছে। তারপর ইটালি, স্পেন, যুক্তরাজ্যর মতো দেশগুলি থেকে যে ভারতীয়রা ফিরেছেন, বিদেশিরা এসেছেন, তাঁদের মাধ্যমে করোনা ছড়িয়েছে। বিদেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে বিদেশ থেকে আসা লোকেদের ১৪ দিনের নিভৃতবাসের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। তা করা হয়নি। বিমানবন্দরে নামকোয়াস্তে একটা থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা ছিল মাত্র।

কোনো জায়গা বন্ধ করা হয়নি। সংসদের অধিবেশন চলেছে। সব অফিস-কাছাড়ি খোলা। সভা-সমাবেশ, ধর্মীয় উৎসব, বিয়ে বাড়ি সবই চলছে। ডনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফর হয়েছে। আমেদাবাদে নমস্তে ট্রাম্পের জমজমাট অনুষ্ঠান হয়েছে । মধ্যপ্রদেশে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ও তাঁর অনুগামীরা বিদ্রোহ করেছেন। করোনার মধ্যেই সরকারের বদল হয়েছে। তারপর হঠাৎ, সবকিছু সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়া হলো। পুরো দেশ স্তব্ধ। ট্রেন, বাস, বিমান, গাড়ি, স্কুটার, অটো কিছুই চলছে না। শুধু চলছেন বিপন্ন পরিযায়ী শ্রমিকরা। কেউ কয়েকশ কেউ বা হাজার কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে প্রায় অভুক্ত অবস্থায় পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইলেন। অনেকে পথেই মারা গেলেন। 

কোথাও কোনো কাজ নেই। রাতারাতি ১২ কোটি লোক বেকার। যাদের চাকরি থাকলো, তাদের বেতন কমল। প্রধানমন্ত্রী মালিকদের অনুরোধ করলেন, কারো যেন চাকরি না যায়। এই উপমহাদেশে এই ধরনের অনুরোধের কি অর্থ আছে? এখানে একটা কথাই চলে। হয় আইন কর, না হলে শুধু অনুরোধে কাজ হবে না। হলোও না। অসংগঠিত ক্ষেত্র প্রায় বন্ধ। সংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরি যাওয়ার হিড়িক। কোটি কোটি লোক বেকার।

আমাদের তো আর উন্নত দেশগুলির মতো সামাজিক সুরক্ষা নেই যে, চাকরি গেলে রাষ্ট্র বেকার ভাতা দেবে। সেই অর্থে দিনযাপনের কোনো অসুবিধা হবে না।  তাও তো সরকার গরিব মানুষের অ্যাকাউন্টে পাঁচশ টাকা দিয়েছে। গরিবদের বিনা পয়সায় চাল-গম দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু বাকিরা, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত?

মুসকিলটা হলো, দীর্ঘ লকডাউনের পরেও করোনাকেও ঠেকানো গেল না। লোকের কর্মসংস্থানও বাঁচানো গেল না। অর্থনীতিও নয়। লকডাউন যখন ঘোষণা করা হয়, তখন দিনে ৫০০ লোক করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এই বৃহস্পতিবার আক্রান্ত হয়েছেন ৬৯ হাজারের বেশি লোক। এখনো প্রায় সব খোলা। মাঝে এতদিন সবকিছু বন্ধ রেখে তা হলে হলোটা কি? সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কি সবদিক ভাবা হয়েছিল?

এ বার বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ হলো ৬৯ হাজার কোটি টাকা। একেবারে ফেলে দেয়ার মতো অর্থ নয়। তা সত্ত্বেও করোনাকালে আমরা দেখলাম, সরকারি হাসপাতালের অবস্থা কতটা শোচনীয়। আর বেসরকারি হাসপাতাল তো যথারীতি লোকের পকেট কাটার কল। তা হলে এই বিপুল পরিমাণ টাকা যায় কোথায়? অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করার পর বলেছিলেন, গরিবদের স্বাস্থ্যবিমা বা আয়ুষ্মান ভারতের জন্য বিপুল বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রত্যেক পরিবারের জন্য বছরে পাঁচ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবিমা করা হয়েছে। তা হলে এই বিমার মধ্যে করোনা চিকিৎসার খরচ তো ঢুকিয়ে দেয়া যেত। এমনিতে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ লাগে না। বেসরকারি হাসপাতালের জন্য ওই বিমা যথেষ্ট ছিল। মুশকিল হলো, করোনা যত ছড়িয়েছে, তত দেখা গেছে হাসপাতালে পরিকাঠামোই নেই। তাই সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না। রোগীর সংখ্যা পাছে বেড়ে যায়, তাই দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা বেঁধে দেয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের ধমক খেয়ে পরীক্ষার সংখ্যা প্রায় পাঁচগুণ বাড়ায় দিল্লি সরকার। তৈরি হয় করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা।

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

শিক্ষার অবস্থা তো আরো শোচনীয়। এই সময় বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো মানে করোনার মুখে ঠেলে দেয়া। ফলে কোনো দেশই তা চায়নি। ইউরোপের দেশেও করোনার প্রকোপ কমার পর স্কুল খুলেছে। দ্বিতীয়.বার করোনা ফিরে আসায় আবার তা বন্ধ রাখার কথা ভাবা হচ্ছে। ভারতে তো করোনার প্রথম ধাক্কাই সামলানো যায়নি। ফলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আপাতত ৩১ অগাস্ট পর্যন্ত বন্ধ। প্রশ্ন হলো, বাচ্চাদের তা হলে কীভাবে পড়ানো হবে? শুরু হলো ডিজিট্যাল শিক্ষা। এখানেও মুসকিল। ডিজিটাল শিক্ষায় যোগ দিতে গেলে স্মার্ট ফোন চাই। তাতে ভালো নেট সংযোগ চাই। ভারতে ইন্টারনেটের খরচ খুব বেশি নয়। গরিবদের হাতেও এখন স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট পরিষেবা থাকে।  কিন্তু অনেক গরিব পরিবারে একটা মাত্র স্মার্ট ফোন থাকে। সেটা বাবা বা মা নিয়ে বেরিয়ে গেলে বাচ্চারা ক্লাস করবে কী করে। আর গ্রামের দিকে ফোনে ইন্টারনেটের অবস্থা খুব খারাপ। সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, সরকারি কেন্দ্রীয় স্কুলের বাচ্চাদের অধিকাংশের কাছে স্মার্ট ফোন নেই।

পশ্চিমবঙ্গে তো আবার সপ্তাহে এক থেকে দুই দিন লকডাউন শুরু হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তের কারণ কী? সেই করোনার চেইন ভাঙার ব্যবস্থা হচ্ছে। এতে কী লাভ হচ্ছে কে জানে, সব খুলে দিয়েও আবার বন্ধ করার পিছনে কী অর্থ থাকে তা বোঝা যাচ্ছে না। 

তবে দোষটা কি শুধু সরকারের, লোকেদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? লকডাউনের সময় কলকাতার বাজারের চেহারা দেখে তা মনে হয়নি। যেন মোচ্ছব চলছে। লোকের ভিড়ে ভিড়াক্কার। মাছ কেনার হিড়িক। সামাজিক মাধ্যমে রান্নার ছবি পোস্ট করা। অকারণে বাইরে বের হওয়া। সামাজিক দূরত্বের তোয়াক্কা না করা। মাস্ক লাগিয়েও তা মুখের নীচে নামিয়ে রেখে দেয়া। কিছু না হোক চায়ের আড্ডায় বসে যাওয়া। পুলিশ তাড়া দিলে পাল্টা হুংকার, চা-ও খাব না?  

বহুদিন আগে দাদাঠাকুর গান বেঁধেছিলেন, কলকাতা কেবল ভুলে ভরা। করোনা নিয়ে সরকার ও লোকের আচরণ দেখে কেমন যেন মনে হচ্ছে, তাদের সিদ্ধান্তও কেবল ভুলে ভরা। আরেকটু চিন্তাভাবনার দরকার ছিল সকলের।

১৬ এপ্রিলের ছবিঘরটি দেখুন...

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য