1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনাল শেষে মেসির হাতে বিশ্বকাপ

সামীউর রহমান
১৮ ডিসেম্বর ২০২২

শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে ৪-২ ব্যবধানে হারিয়ে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতল আর্জেন্টিনা৷ ঘুচলো ৩৬ বছরের অপেক্ষা৷

https://p.dw.com/p/4L8Se
Argentinien Weltmeister | Fußball WM Katar Finale | Argentinien v Frankreich
ছবি: Julian Finney/Getty Images

জাদুকর খুলেছেন তার জাদুর ঝাঁপি৷ যুবরাজ দেখিয়ে দিয়েছেন আগামীর সাম্রাজ্য তার৷ তবুও কাতার বিশ্বকাপের চূড়ান্ত শিরোপা নিষ্পত্তি হলো গনজালো মন্তিয়েলের গড়ানো শটে৷ হাজার তারার ভিড়ে টিমটিম করে জ্বলা প্রদীপেই জ্বলে উঠল আর্জেন্টিনার জয়ের মশাল, ঘুচলো ৩৬ বছরের অপেক্ষা৷

শ্বাসরুদ্ধকর, স্নায়ুক্ষয়ী, থ্রিলার…কোনো শব্দই আসলে যথেষ্ট নয় বিশ্বকাপ ফাইনালের পাগুলে ১২০ মিনিটের বিশেষণ হিসেবে৷ শুধু বলা যায়, এরকম ফুটবল ম্যাচ নিয়মিত হলে হৃদরোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে৷ নির্ধারিত সময়ে ২-২ গোলে সমতা, অতিরিক্ত সময়ে ৩-৩ গোলে সমতা৷ শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকার নামক ভাগ্যের খেলাতেই হারজিতের ফয়সালা৷ তাতে আর্জেন্টিনার হয়ে চতুর্থ শট নিতে আসা মন্তিয়েলের পাঠানো বলটা জালে ঢুকতেই নিশ্চিত হয়ে যায়, অবশেষে বিশ্বকাপ জিতলেন লিওনেল মেসি৷ শেষ বিশ্বকাপে, শেষ ম্যাচে, শেষ মুহূর্তে নিশ্চিত হলো মেসির বিশ্বকাপ৷

Argentinien Weltmeister | Fußball WM Katar Finale | Argentinien v Frankreich
৩৬ বছরের অপেক্ষা ঘুচল আর্জেন্টিনারছবি: ANNE-CHRISTINE POUJOULAT/AFP

রবিবারের লুসাইল স্টেডিয়ামকে বুয়েনস আইরিস থেকে আলাদা করা যায়নি৷ ৮৮ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়ামের সিংহভাগই আকাশী নীলদের দখলে৷ শুধু যে আর্জেন্টিনা থেকে সমর্থকরা গিয়ে হাজির হয়েছেন এমন নয়, গোটা বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে আর্জেন্টিনার আকাশী-নীলে নিজেকে রাঙিয়ে অনেকে হাজির হয়েছেন বিশ্বকাপ ফাইনালের মঞ্চে৷ ফুটবলের জাদুকরের সেরা জাদুর সাক্ষী হতে৷ অবশেষে বিশ্বকাপটা ধরা দেবে লিওনেল মেসির হাতে, শোধ হবে ফুটবলের দায়, মুছে যাবে সব বিতর্ক৷

সমশক্তির দুই দলের স্নায়ুর চাপের ম্যাচগুলো সাধারণত নিষ্পত্তি হয় অসাধারণ কোনো নৈপুণ্যে অথবা কারো মারাত্মক ভুলে৷ ২০১৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে মারিও মান্দজুকিচের আত্মঘাতী গোল সেই যে পিছিয়ে দিলো ক্রোয়েশিয়াকে, আর তাদের ম্যাচে ফেরাই হলো না৷ রবিবার রাতে লুসাইলে সবচেয়ে বড় ভুলটা উসমান ডেম্বেলের৷ আনহেল ডি মারিয়াকে আলতো ছোঁয়ায় বক্সের ভেতর যেভাবে অপ্রয়োজনে ফেলে দিলেন, তাতেই ম্যাচের ২৩ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দিলেন লিওনেল মেসি৷

চোট আর চিকিৎসার লুকোচুরিতে বার্সেলোনার হয়ে মাঠে খুব কমই দেখা যায় ডেম্বেলেকে৷ বিশ্বকাপেও তার একাদশে জায়গাটা পাকা হয়েছে করিম বেনজেমার বিদায়ে৷ রাইট উইঙ্গার ডেম্বেলে গোটা বিশ্বকাপেই ছিলেন নিষ্প্রভ৷ ফাইনালে উইং থেকে নীচে নেমেছিলেন রক্ষণে সহায়তা করতে, রাইটব্যাক জুলস কুন্দের কোনো কাজেই আসেননি ডেম্বেলে বরং ডি মারিয়াকে ফাউল করে আর্জেন্টিনাকে দিয়েছেন পেনাল্টি উপহার৷

এবারই প্রথম বিশ্বকাপে কোনো দল পাঁচটা পেনাল্টি পেলো৷ বিশ্বকাপে মেক্সিকো এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দু’টো বাদে প্রতিটি ম্যাচেই পেনাল্টি পেয়েছে আর্জেন্টিনা৷ একমাত্র পোল্যান্ডের বিপক্ষেই স্পটকিকে গোল করতে পারেননি মেসি, বাকি সবগুলোতেই পেয়েছেন সাফল্য৷ বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বে সৌদি আরবের বিপক্ষে পেনাল্টিতে গোল করার পর কোয়ার্টার ফাইনাল,সেমিফাইনাল ও ফাইনালে যথাক্রমে নেদারল্যান্ডস,ক্রোয়েশিয়া এবং ফ্রান্সের বিপক্ষে পেনাল্টি পেলো আর্জেন্টিনা এবং গোল করেন মেসি৷ রেফারিং নিয়ে বিশ্বকাপে অনেক দলই উচ্চকিত৷ ডাচ ফুটবল ফেডারেশনের টুইটারে স্প্যানিশ রেফারি মাতেউ লোহাজকে বিশ্বকাপে আর ম্যাচ পরিচালনায় না রাখার খবর শেয়ার করে লেখা হয়েছে, ‘যাবার আগে কাজটা ঠিকভাবে করে গেছে’৷ 
পর্তুগালের পেপে এবং ব্রুনো ফার্নান্দেসের মতো খেলোয়াড়রাও ক্ষিপ্ত হয়ে বলেছেন ‘‘কাপটা আর্জেন্টিনাকে দিয়ে দিলেই পারে’৷’ ফাইনালে রেফারি নিয়ে বিতর্ক পিছু ছাড়লোনা আর্জেন্টিনাকেও৷ ১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে রেফারি কোডেসালের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে জিতেছিল জার্মানি, এবার সম্ভবত সেই প্রায়শ্চিত্ত মেসিকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে!
পেনাল্টিতে এগিয়ে যাবার আগে অবশ্য আর্জেন্টিনাই প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিল খেলায়৷ আর্জেন্টিনার গোলের প্রচেষ্টা ছিল ৬টি, অন্যদিকে ফ্রান্স গোলের কোনো চেষ্টাই করেনি প্রথমার্ধে৷ আর্জেন্টিনার ৬টি প্রচেষ্টার ৩টিতেই গোলপোস্টে ছিল শট, ফ্রান্সের শূন্য৷ আর্জেন্টিনা পায় দুটো কর্নার, ফ্রান্সের সেই শূন্য৷

Fußball WM Katar Finale | Argentinien v Frankreich
ফাইনালে ডি মারিয়া ছিলেন অনবদ্যছবি: KIRILL KUDRYAVTSEV/AFP

সমতা ভেঙে যাবার পর আরো আগ্রাসী হয়ে ওঠে আর্জেন্টিনা৷ ডায়ো উপমেকানোর বাড়ানো বলে আক্রমণে উঠছিল ফ্রান্স, সেখান থেকে কাউন্টার অ্যাটাকে মেসি এবং জুলিয়ান আলভারেজ তিরের মতোই ছুটে যান প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের দিকে৷ মেসির কাছ থেকে বলটা চলে যায় অ্যালেক্সিস ম্যাকঅ্যালিস্টারের কাছে, বামপ্রান্ত দিয়ে উঠতে থাকা ডি মারিয়াকে বলটা বাড়িয়ে দেন ম্যাকঅ্যালিস্টার৷ আগুয়ান হুগো লরি শরীরটা পেতে দিয়েছিলেন বলের লাইনে, কিন্তু ডি মারিয়া মেরেছেন ফরাসি গোলরক্ষকের শরীরের উপর দিয়ে৷ ফাইনালে কিক-অফের ৩৬ মিনিটেই ২-০ গোলে এগিয়ে আর্জেন্টিনা, বাস্তিল দূর্গের পতন এক অর্থে সেখানেই৷

Fußball WM Katar Finale | Argentinien v Frankreich
১৯৬৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে প্রথমবার ইংল্যান্ডের জিওফ হার্স্টের পর ফ্রান্সের এমবাপ্পে বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাটট্রিক করলেনছবি: Catherine Ivill/Getty Images

প্রথমার্ধেই দুই গোল হজমের পর একাদশে জোড়া পরিবর্তন আনেন দিদিয়ের দেশম৷ ডেম্বেলে আর অলিভিয়ের জিরুকে তুলে নিয়ে নামান র‍্যান্দাল কোলো মুয়ানি আর মার্কাস থুরামকে৷ তাতেও খুব একটা ধার বাড়েনি আক্রমণে, বরং বিরতির পর আর্জেন্টিনা তৈরি করেছে আরো কয়েকটি সুযোগ৷ উলটোদিকে ম্যাচের প্রথম ১ ঘণ্টায় ফ্রান্সের কোনো ‘শট অন টার্গেট’ নেই! ৬৩ মিনিটের মাথায় কাউন্টার অ্যাটাকে ওয়ান-অন-ওয়ান পরিস্থিতিতে মুখোমুখি ম্যাকঅ্যালিস্টার ও লরি৷ ফরাসি গোলরক্ষক বলটা ছিনিয়ে না নিলে তৃতীয় গোলটাও পেয়ে যেতে পারতো আর্জেন্টিনা৷

শেষের ত্রিশ মিনিটে আস্তে আস্তে রক্ষণের অর্গল বন্ধ করতে থাকেন আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি৷ ফাইনালে আর্জেন্টিনার সেরা খেলোয়াড় ডি মারিয়াকে তুলে নিয়ে মার্কোস আকুইনাকে নামিয়ে রক্ষণের জোর বাড়ান৷

৭০ মিনিটের দিকে প্রথম এমবাপ্পেকে দেখা যায় কিছু একটা করতে৷ বাম দিক দিয়ে বক্সের ভেতের ঢুকেছিলেন, তারপর বল মেরেছেন পোস্টের উপর দিয়ে৷

শেষদিকে বাড়ে নাটকীয়তা৷ কোলো মুয়ানিকে ফাউল করেন নিকোলাস ওতামেন্দি, পেনাল্টির সংকেত রেফারির৷ ডানদিকে ঝাঁপিয়েছিলেন এমিলিয়েনো মার্তিনেজ, অল্পের জন্য বাঁচাতে পারেননি এমবাপ্পের নেয়া স্পটকিক৷ স্কোরলাইন ২-১ করে ফেললো ফ্রান্স৷

পরের মিনিটে যেটা হো, সেটা আর্জেন্টিনার দুঃস্বপ্ন৷ মেসির পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে আক্রমণের সূচনা করলেন কিংসলে কোমান৷ দিলেন এমবাপ্পেকে৷ এই ফরাসি স্ট্রাইকারের জোরাোল ভলি গোটা শরীর হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েও বাঁচাতে পারলেন না এমিলিয়ানো মার্তিনেজ৷ নব্বই মিনিট শেষের ৯ মিনিট আগে, ২-২ সমতা করে ফেললো, ২ মিনিটে ২ গোলে খেলায় ফিরলো ফ্রান্স৷

শেষ বাঁশির মিনিট দুয়েক আগে, আবারো আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেয়ার সেরা সুযোগটা পেয়েছিলেন মেসি৷ বক্সের প্রান্ত থেকে বাম পায়ের শট সোজাসুজি মিসাইলের মতোই ছুটে যায় ফরাসি গোলপোস্টে, কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেন লরি৷ ২-২ সমতায় শেষ হয় নির্ধারিত সময়ের খেলা, অমীমাংসিত থাকায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে৷

Argentinien Weltmeister | Fußball WM Katar Finale | Argentinien v Frankreich
কিংবদন্তী ম্যারাডোনার পর অবশেষে এ কালের সেরা মেসির হাতে এল বিশ্বকাপছবি: Julian Finney/Getty Images

১০২ মিনিটে জুলিয়ান আলভারেজকে তুলে লাউতারো মার্তিনেজকে নামিয়েছিলেন স্কালোনি৷ অবিশ্বাস্য দুটো মিস করেছেন এই ফরোয়ার্ড৷ উপমেকানো হেড করে ফিরিয়েছেন একটা শট আর অন্যটা সামনে শুধুই গোলরক্ষককে পেয়ে মার্তিনেজ মেরেছেন বাইরে৷

শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার তৃতীয় গোলেও সেই মার্তিনেজেরই ছোঁয়া৷ অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে ডানপ্রান্ত দিয়ে ঢুকে জোরালো এক শট নিয়েছিলেন মার্তিনেজ, লরি সরাসরি শরীর পেতে দিয়েছিলেন বলের সামনে৷ শক্তিশালী শটটা লরির শরীরে লেগে ফিরে আসে, ফিরতি বল মেসি পাঠিয়ে দেন জালে৷ গোললাইনের ভেতর থেকে কুন্দে বল ফেরত পাঠালেও গোললাইন প্রযুক্তি জানিয়ে দেয় বল পেরিয়েছে ‘লক্ষণরেখা’৷

পিছিয়ে পড়েও ফিরে আসা ফ্রান্স ফিরে আসে আবারও৷ মন্তিয়েলের হ্যান্ডবলে ১১৮ মিনিটে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স, তাতে গোল করে হ্যাটট্রিক করেন এমবাপ্পে৷ ১৯৬৬-তে ইংল্যান্ডের জিওফ হার্স্টের পর বিশ্বকাপের ফাইনালে প্রথম হ্যাটট্রিক৷ তাতেই খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে৷

মেসি, এমবাপ্পে দুজনেই নিজ নিজ দেশের হয়ে প্রথম শটটা নিতে আসেন এবং গোল করেন৷ কোমান আর চুয়ামেনি দুজনেই গোল করতে ব্যর্থ হয়েছেন, আর আর্জেন্টিনার সবাই গোল করেছেন প্রথম চার স্পটকিকে৷ টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে জিতে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতলো আর্জেন্টিনা, ১৯৮৬ সালের পর প্রথম৷ তাতেই মুছে গেল শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সব বিতর্ক৷ পৃথিবী নামের এই গ্রহের সেরা ফুটবলারের নাম লিওনেল মেসি৷

ফাইনালে হ্যাটট্রিকসহ আট গোল করে গোল্ডেন বুট নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেন ২৩ বছর বয়সি এমবাপ্পে৷ আর মেসি জিতলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বল৷ সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার পেলেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক মার্টিনেজ, এবং চ্যাম্পিয়ন দলের উঠতি খেলোয়াড় অ্যানসো ফার্নান্ডেজ পেলেন সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরস্কার৷