শিশুরাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে
করোনা সংক্রমণের মধ্যে হানা দিয়েছে ডেঙ্গু৷ ঢাকা শিশু হাসপাতালে গত দুই সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে রেকর্ড সংখ্যক রোগী ভর্তি হয়েছে৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৮,৮৫৩ জন৷
শিশু হাসপাতালে রেকর্ড
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. সফি আহমেদ বুধবার জানান, প্রতিদিনই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে৷ গত শনিবার একদিনেই হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছে ৮০ শিশু৷ তিনি আরও বলেন, শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সংখ্যা বিগত কয়েক বছরের রেকর্ড ভেঙেছে৷
পরিস্থিতি সামাল দিতে আলাদা কর্নার
ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের যথাযথভাবে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে ঢাকা শিশু হাসপাতালে পৃথকভাবে ‘ডেঙ্গু কর্নার’ চালু করা হয়েছে৷ এছাড়া রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাদের এইচডিইউ এবং আইসিইউতে স্থানান্তর করা হচ্ছে৷
অভিভাবকদের সচেতনতার বিকল্প নেই
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. সফি আহমেদ জানান, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অধিকহারে ডেঙ্গু আক্রান্তের কারণ হলো, তারা ছোট বিধায় মশার কামড় খুব একটা অনুভব করে না, অথবা মশা তাড়াতে পারে না৷ ডেঙ্গু মশা বিশেষত হাঁটুর নিচে কামড়ায়৷ তাই এই ডেঙ্গুর মৌসুমে বাচ্চার বাবা-মাদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে এবং বাসার চারপাশ পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে৷
‘অনেক গরম, তাই মশারি দেই নাই’
শিশু হাসপাতালের ‘ডেঙ্গু কর্নার’এ গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার একটি অংশের ১৫টি বেডের কোনোটিতেই মশারি টানানো নেই৷ কেন মশারি দেননি, জিজ্ঞেস করায় মোতালেব হোসেন নামে রোগীর এক স্বজন বললেন, ‘‘হাসপাতালের ভিতর অনেক গরম, পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নাই৷ বাচ্চারা মশারির ভিতরে থেকে অস্থির হয়ে যায়, তাই মশারি খুলে দিয়েছি৷ বিকেলের পর আবার টানাব৷’’
আক্রান্ত হচ্ছে পরিবারের একাধিক সদস্য
মোছাঃ কুলসুম আক্তার তার ৯ মাস এবং ৭ বছর বয়সি দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে এসেছেন সাতদিন আগে৷ তার দুই সন্তানই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত৷ অন্যান্য অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের পরিবারে এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে একই পরিবারের একাধিক সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন৷
তরল খাবার মানে শুধু স্যালাইন নয়
ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ জোহরাফ মুনা বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুরা অনেক নাজুক থাকায় তাদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাবধান থাকতে হয়৷ ‘‘আমরা বাচ্চাদের অবস্থা বুঝে তাদের অভিভাবকদের তরল খাবার মুখে খাইয়ে দিতে বলি৷ কিন্তু তরল মানেই শুধু স্যালাইন ভেবে তারা ভুল করেন৷ ডাবের পানি, ফলের রস, পানি, স্যুপ এগুলোও তরল খাবার হিসেবে খাওয়াতে হবে’’ বলেন তিনি৷
জ্বর সারলেই বিপদ কাটে না
ডা. জোহরাফ মুনা আরও বলেন, ‘‘অনেক সময় বাচ্চাদের জ্বর কমে গেলে অভিভাবকরা ভাবেন বাচ্চা সুস্থ হয়ে গেছে৷ কিন্তু জ্বরের পরেই বাচ্চা শকে চলে যেতে পারে, একে আমরা বলি ক্রিটিকাল ফেইজ৷ সাধারণত যেসব বাচ্চার কো-মরবিডিটি অর্থাৎ ডায়াবেটিস, স্থূলকায়সহ অন্যান্য জটিল সমস্যা আছে, তাদের এই অবস্থায় যাওয়ার সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি৷’’
সরকারের মশার ওষুধ কাজ করে না
ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা অভিভাবকেরা জানান, সরকার থেকে যে মশার ওষুধ স্প্রে করা হয় তা দিয়ে এখন আর মশা কমে না৷ বরং ধোঁয়ার কারণে বাইরের মশা ঘরে ঢুকে যায়৷ উত্তর বাড্ডা থেকে আসা আফরিন নাহার নামের একজন অভিভাবক জানান, শীতকালে তাদের এলাকায় মশার কারণে ঘরে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে৷
খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে
একাধিক হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, সেখানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বাচ্চাদের অনেকের শারীরিক জটিলতার কারণে এইচডিইউ ও আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়৷ কিন্তু চিকিৎসা খরচ বেশি হওয়ায় অভিভাবকরা বিপদে পড়ে যান৷ নরসিংদীর জামিল উদ্দীন বলেন, ‘‘চিকিৎসকেরা ছেলেকে আইসিইউতে নিতে চাইতেসে৷ সেখানে একবারে ত্রিশ হাজার টাকা জমা দিতে হবে৷ আমি ১০ হাজার দিতে চাইলে তারা রাজি হয় নাই৷ এত টাকা একবারে কই পাব সেটা নিয়া দুশ্চিন্তায় আছি৷’’
সামর্থ্যবানেরা ছুটছেন বেসরকারি হাসপাতালে
ঢাকার একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, সেখানেও ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চাপ রয়েছে৷ কেন সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে এখানে এসেছেন জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার-নার্সদের সাথে কথাই বলা যায় না৷ বাচ্চা রোগীদের এটেনডেন্টদের থাকার জায়গা নেই৷ এখানে খরচ বেশি হলেও সবকিছু বিবেচনা করে এসেছি৷ আর্থিকভাবে কষ্ট হলেও কিছু করার নাই৷’’
ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ছয় হাসপাতাল
সরকার ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ব্যাপারে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকায় ছয়টি সরকারি হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করেছে৷ সেগুলো হচ্ছে মিটফোর্ড হাসপাতাল, শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার হাসপাতাল, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতাল, লালকুঠি হাসপাতাল এবং কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যা হাসপাতাল৷