শিল্পী ও সাহিত্যিকদের গ্রীষ্মকালীন আবাস
শহরের প্রচণ্ড গরমে একটু আরাম আর ঠান্ডা হওয়ার আশায় মানুষ চলে যায় গ্রামে অথবা সাগর পাড়ে৷ কেউ চলে যান দূরে কোনো গ্রামে নিরিবিলিতে কাজ করার জন্য৷
সৈকতের সৌন্দর্য
বাল্টিক সাগরে সবুজে ঘেরা রাস্তা এতটাই সুন্দর, যা লেখক টোমাস মানকে মোহিত করেছিল৷ তাঁর মনে হয়েছিল, এমন সুন্দর জায়গায় একটা আস্তানা থাকা দরকার, কিন্তু য টাকা পাবেন কোথায়? একথা ভাবার ঠিক তিনমাস পরেই তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান৷ তখন তিনি লিথুয়ানিয়ার নিদাতে একটি বাড়ি বানিয়ে ফেলেন৷ তবে সেখানে খুব বেশিদিন তাঁর থাকা হয়নি৷ ১৯৩৩ সালে নাৎসি জার্মানি ত্যাগ করেন পর আর কোনো দিনও সেখানে যাওয়া হয়নি তাঁর৷
বুদ্ধিজীবীদের প্রিয় জায়গা – হিডেনসে
গরমকালে গেয়ারহার্ট হাউপ্টমান তাঁর সময় কাটাতেন ব়্যুগেন দ্বীপে, এমনকি হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের পরও৷ শোনা যায়, ১৯৩৩ নাৎসি জমানার প্রতীক ‘স্বস্তিকা’-র চিহ্ন দেয়া একটি পতাকাও তাঁর বাড়িতে শোভা পেত, যদিও তিনি নিজেকে নাৎসি নন বলে দাবি করতেন৷ হাউপ্টমান এই দ্বীপটি এতটাই পছন্দ করতেন যে মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়৷ হিডেনসে হ্রদের ধারে থাকতে পছন্দ করতেন তৎকালীন বহু বুদ্ধিজীবীই৷
পাহাড়ের একাকিত্ব
দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার ব্ল্যাক ফরেস্টের দক্ষিণ দিকে টডনাউব্যার্গে তাঁর ছোট্ট কুটিরে চলে যেতেন থাকার জন্য৷ আর সেটা শুধু গ্রীষ্মকালেই নয়, সারা বছরই সেখানে থাকতে পছন্দ করতেন তিনি৷ সেখানে তিনি নিরিবলিতে তাঁর দর্শনের কাজ করতে পারতেন৷ ওখানেই তিনি তাঁর সুবিখ্যাত লেখা ‘সাইন উন্ড সাইট’ রচনা করেন৷ সেই শান্ত পরিবেশ এখন আর নেই৷
বার্লিনের গ্রীষ্মকালীন ভিলা
চিত্রশিল্পী মাক্স লিবারমান থাকতেন বার্লিনের ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের একেবারে কাছাকাছি৷ তবে গ্রীষ্মকালে তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে চলে যেতেন বার্লিনের সীমানাবর্তী ভানসে হ্রদের ধারে৷ ১৯৩৫ সালে মাক্স লিবারমানের মৃত্যুর পর সমাজতন্ত্রীরা তাঁর বাড়িটি বাজেয়াপ্ত করে৷ পরে বাড়িটিতে তৈরি করা হয় একটি ডুবুড়ি ক্লাব৷ বর্তমানে অবশ্য ঐ ভিলাটি একটি মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে, যেখানে বছরে প্রায় ৮০ হাজার পর্যটক এসে থাকেন৷
শহর থেকে দূরে
সাহিত্যিক হাইনরিশ ব্যোল মনে করেন, এত বেশি গাড়ি চলার কারণে বিশ্বের প্রতিটি শহরেরই শান্তি নষ্ট হচ্ছে৷ তাঁর নিজের বাড়ি কোলন শহরও এর থেকে মুক্ত নয়৷ তাই তিনি যখনই সুযোগ পেয়েছেন তখনই চলে গেছেন কোলের অদূরে আইফেল শহরের কাছাকাছি লাঙেনব্রয়েশ-এর খামার বাড়িতে৷ এই নিরিবিলি জায়গাটিকে সারা বিশ্বের সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পীরা অনেক আগে থেকেই নিরিবিলি একটি আশ্রয় স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন৷
গ্যোয়েটের বাগান বাড়ি
ইতিহাসের পাতা ধরে একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকানো যাক৷ ইয়োহান ভল্ফগাং ফন গ্যোয়েটেও পছন্দ করতেন শান্ত এবং নিরিবিলি পরিবেশ৷ ১৭৭৫ সালে ভাইমারে তাঁর প্রথম বাড়িটি ছিল একটি ‘ওয়াইনব্যার্গহাউস’, যা বর্তমানে ‘গ্যোয়টের গার্ডেন হাউজ’ বা গ্যোয়টের বাগান বাড়ি নামে পরিচিত৷ গ্যোটে ১৭৮২ সালে, অর্থাৎ শহরে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এখানেই ছিলেন৷ এই বাড়িটি এখনও এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাড়ি হিসেবেই রয়ে গেছে৷
সারা বছরই গ্রীষ্মকালের মতো সুন্দর
শুধু গ্রাষ্মীকালেই সুন্দর থাকা কেন? সারা বছরই তো ভালো থাকা যায়৷ তাই শিল্পী দম্পতি গাব্রিয়েলে ম্যুন্টার ও ভাসিলি কানডিন্সকি ১৯০৯ সালে জার্মানির দক্ষিণে অবস্থিত বাভারিয়ার মুরনাউ-এ একটি বাড়িতে ওঠেন, যে বাড়িটিতে শুধু গ্রীষ্মে ছুটি কাটানোর কথাই ভাবা হয়েছিল৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ান শিল্পী কানডিন্সকিকে বাড়িটি ছেড়ে চলে যেতে হয়৷ বাড়িটি বর্তমানে একটি মিউজিয়াম৷
শিল্পীদের পছন্দ গ্রাম
মুরনাউয়ের কাছেই ১৯০৯ সালে চিত্রশিল্পী ফ্রানৎস মার্ক থাকতেন৷ মিউনিখ শহরে তাঁর ‘আটেলিয়ের’ বা ছবি আঁকার ‘স্টুডিও’-টি ছেড়ে দিয়ে তিনি থাকতে শুরু করেন সিন্ডেনডর্ফের একটি কাঠের মিস্ত্রীর ওস্তাদের বাড়িতে৷ তিনি এবং কানডিন্সকি – দু’জনে মিলে তৈরি করা সেই বাড়িতেই এঁকেছিলেন বিখ্যাত ‘দ্য ব্লু রাইডার’ ছবিটি৷ মার্ক অবশ্য সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেননি৷ ১৯১৬ সালে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেন তিনি৷
ট্রুবেলস থেকে অনুপ্রেরণা
জার্মানির খ্যাতনামা নাট্যকার ব্যার্টল্ড ব্রেশ্ট এবং হেলেনে ভাইগেল থিয়েটার করতেন বার্লিনে আর গ্রীষ্মকালটা কাটাতে পছন্দ করতেন গ্রামে৷ ১৯৫২ সালে সুইজারল্যান্ডের বুকো-তে তাঁরা গ্রীষ্মকালীন কুটিরে চলে যেতেন৷ উপভোগ করতেন গ্রামের নির্মল বাতাস৷ নাট্যকার ব্রেশ্ট এই সুন্দর পরিবেশকে লেখার জন্য কাজে লাগাতেন৷ বর্তমানে জায়গাটি একটি স্মরণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে৷অনেক সময় বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্যও এটি ব্যবহার করা হয়৷