লাস ফালাস, ভ্যালেন্সিয়ার অগ্নি যজ্ঞ!
১৮ মার্চ ২০১০শুরুর কথা
উৎসবের শুরু সেই মধ্যযুগ থেকে৷ কাঠমিস্ত্রীদের ‘দেবতা পিতা' হিসেবে পূজিত সেন্ট জোসেফ এই অগ্নি যজ্ঞের মূল চরিত্র৷ মধ্যযুগে কাঠমিস্ত্রীরা বসন্তের শুরুতে শীতের জমিয়ে রাখা অপ্রয়োজনীয় কাঠ, সরঞ্জামাদি একত্রে জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলতো৷ সেই ঐতিহ্য থেকে শুরু হয়ে এখন তা রূপ নিয়েছে মহোৎসবে৷ যুক্ত হয়েছে আরও নানা আচার৷ নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা আর নানা সংস্থা আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে বানায় কাঠ, প্যাপিয়ারম্যাশে'র তৈরি বিশাল সব ভাস্কর্য, স্থাপনা কিংবা কাল্পনিক চরিত্র৷ তবে, বলাই বাহুল্য ক্ষণস্থায়ী এসব শিল্পকর্ম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে ব্যাঙ্গাত্মক৷ বানানো হয় দেশি-বিদেশী রাজনীতিবিদ, তারকা, এবং সিনেমা, কার্টুন কিংবা গল্প-উপন্যাস বা রূপকথার চরিত্রও৷ কয়েকদিন ধরে সারা নগরে তা প্রদর্শন শেষে উৎসবের শেষদিনে এসব পুড়িয়ে ফেলা হয়৷ আর এ রীতি থেকেই উৎসবের নাম ‘লাস ফালাস' বা ‘আগুন উৎসব'৷
কি হয় আগুন উৎসবে
মার্চ মাসের এক তারিখ থেকেই অনুষ্ঠান শুরু হলেও মূল উৎসব ১৫ থেকে ১৯ মার্চ৷ উৎসবের শেষ দিনটি সারা স্পেনে সেন্ট জোসেফ এর সম্মানে ‘পিতার দিবস' হিসেবে উদযাপিত হয়৷ এই দিনেই মানুষ একের পর এক মিছিল করে নিয়ে আসতে থাকে তাদের প্রতিমাসম এইসব শিল্পকর্ম৷ আর তা আগুনে পুড়িয়ে বিসর্জন দেওয়া হয় পিতার নামে৷ যাতে সব অশুভ দূর হয়ে নতুন শুভ দিনের দিকে যাত্রা করতে পারে মানুষ৷ মার্চের ১৯ তারিখে ভ্যালেন্সিয়া যেন আগুনে জ্বলতে থাকা এক আদিভৌতিক নগরীতে পরিণত হয়৷ চারদিকে আগুন আর আগুন, বাজি আর পটকা ফোটার শব্দ, ফড় ফড় করে আগুনে পুড়ছে সব, বাতাসে পোড়াগন্ধ, আর এর মধ্যেই অগুণতি মানুষের উল্লাস, সঙ্গীত-নৃত্যের আনন্দধ্বনিতে অগ্নিযজ্ঞে মত্ত ভ্যালেন্সিয়া৷ এ যেন সম্রাট নিরো'র আগুনে পুড়তে থাকা রোম৷
উৎসবের প্রস্তুতি
আজকাল ভ্যালেন্সিয়ার সব এলাকারই নিজস্ব উৎসব আয়োজক পরিষদ আছে৷ এরাই ‘নিনো' বা এসব পাপেট বানানোর প্রয়োজনীয় অর্থ যোগাড় এবং উৎসবের অন্যান্য কাজকর্মের তদারকি করে থাকে৷ এমনকি ‘সিউতাত ফালেরা' নামে নগরের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় এজন্য স্থাপন করা হয় একটি বিশেষ শিবিরের৷ যেখানে প্রায় মাসখানেক ধরে শিল্পী কলাকুশলীরা বিশালাকৃতির সব নিনো, ট্যাব্লো বানিয়ে থাকে৷ এসব ব্যাঙ্গাত্মক চরিত্রের পাপেটের আকার এমনকি ২০ ফিট উঁচুও হয়৷ তবে অবশ্যই সবগুলোই প্রমাণ আকৃতির চেয়ে বড়৷ ব্যাঙ্গের পাশাপাশি থাকে অনেক কাল্পনিক চরিত্রও৷ থাকে অনেক অদ্ভুতুড়ে প্রতিকৃতিও৷
মূল আয়োজন
নানা ছোটোখাটো আচারের মধ্য দিয়ে উৎসব শুরু হয় মার্চের ১ তারিখ থেকেই৷ তবে মূল উৎসবের উন্মাদনা শুরু ১৫ মার্চ থেকে৷ তখন নগরের প্রধান প্রধান অনেক সড়কই বন্ধ করে দেওয়া হয়, বাস-ট্রামের রুট পরিবর্তিত হয়ে যায়৷ চারদিকে চলতে থাকে নববর্ষের মতো আতশবাজির খেলা৷ ব্যান্ডের উদ্দাম শব্দে ঝড় তুলে বাদকদল একের পর এক পাপেটের মিছিল নিয়ে প্রদক্ষিণ করতে থাকে সারা নগরী৷ বাছাই করা এলাকায় স্থাপন করা হয় নির্বাচিত সব নিনো, ট্যাব্লো৷ রাস্তাঘাট সাজানো হয় বিশেষ আলোকসজ্জায়৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে রকমারি মুখরোচক খাবারের দোকান৷ পানীয়ের সঙ্গে চলতে থাকে রাতদিনের আড্ডা, হৈ হুল্লোড় আর গান বাজনা৷ তবে মনে রাখতে হবে এই উৎসব কিন্তু শুরু হয় সাত-সকালে৷ একেবারে সকাল আটটায় উদ্দাম বাজনাতেই ভাঙবে আপনার ঘুম৷
আছে প্রতিযোগিতাও
এই সব আয়োজনের নেপথ্যে কিন্তু চলতে থাকে বিভিন্ন এলাকা আর সংগঠনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা৷ লক্ষ্য একটাই সেরা আয়োজনের স্বীকৃতি ও বিজয়ীর সম্মান লাভ করা৷ প্রতিযোগিতা হয় মূলত দুইটি বিষয়ে৷ সেরা পাপেট এবং রাস্তা বা মহল্লার সেরা আলোকসজ্জা৷ তবে, এই প্রতিযোগিতা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও কেবলমাত্র সিটি হল-এর আয়োজন থাকে না প্রতিযোগিতায়৷ সেরা পাপেটকে বিশেষ সম্মান দিয়ে তা পোড়ানো হয় না৷ বরং তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় ‘ফালেরো জাদুঘর'-এ৷ প্রতিবছর একটি করে পাপেট জমা করার পাশাপাশি এই জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে আগুন উৎসবের ইতিহাসও৷
ভ্যালেন্সিয়ার কুমারী
কুমারী মাতা ‘মেরি'র সম্মানে নারীদের জন্য বিশেষ আয়োজন আছে লাস ফালাস উৎসবে৷ ১৭ এবং ১৮ তারিখে হয় কুমারীদের এই অনুষ্ঠান৷ ভ্যালেন্সিয়া রাজ্যের সব জায়গা থেকে হাজার হাজার তরুণী-যুবতী ঐতিহ্যবাহী বর্ণিল পোশাকে ফুল হাতে নিয়ে মিছিল করে আসে ‘প্লাসা দে লা ভিরখেন' বা মাতা মেরির চত্বরে৷ সেখানে সাজানো মেরির বিশালাকৃতির ভাস্কর্যের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় তারা৷ আর এই মিছিলে সামিল নারীদের মধ্যে থেকে প্রতিবছর নির্বাচন করা হয় একজনকে৷ ভ্যালেন্সিয়ার কুমারী হিসেবে গৌরবের অধিকারী হন ওই নারী৷
বিসর্জনের যজ্ঞ
মার্চের ১৫ থেকে ‘প্লাসা দেল আয়ুন্তামিয়েন্তো'-তে ‘লা মাসক্লেতা' নামের প্রতিদিনের আতশবাজির খেলা শেষ৷ এবার বিসর্জনের যজ্ঞে একে একে সারা নগরের সব অপরূপ সুন্দর শিল্পকর্মগুলো পোড়ানো হবে৷ কদিন ধরেই সারা নগরে চলেছে আলোকসজ্জার উৎসব৷ তবে সে শুধু যুদ্ধের মহড়া মাত্র৷ ভ্যালেন্সিয়ার আসল লঙ্কাকাণ্ড উৎসবের শেষ দিন ১৯ মার্চ৷ এই রাতটি হল ‘লা নিত দে ফক' বা ‘আগুনের রাত'৷ সব পাড়া মহল্লার সবাই প্রস্তুত৷ মাসখানেকের বেশি সময় ধরে বহু পরিশ্রমে বানানো, সাজানো পনেরো বিশ ফিটের সব দৈত্যাকার পাপেটগুলোতে ঠাসা হবে বারুদ৷ মধ্যরাতে একত্রে জ্বলে উঠবে ভ্যালেন্সিয়া৷ বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লেগে যাবে, আগুনের হলকায় চোখ ধাঁধিয়ে যাবে, পোড়া গন্ধে ভরে যাবে চারদিক৷ আগুনের প্রলয়যজ্ঞে জ্বলে পুড়ে শুদ্ধ হবে ভ্যালেন্সিয়া৷
প্রতিবেদক : মুনীর উদ্দিন আহমেদ
সম্পাদনা : দেবারতি গুহ