লকডাউনের পর ঢাকা যেমন আছে
প্রায় চার মাস ধরে চলা কঠোর লকডাউন শেষে গত ১১ আগস্ট থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে গণপরিবহন, অফিস-আদালত, বিনোদনকেন্দ্র, শপিং মল ও দোকানপাট৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খুললেও ঢাকার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে৷
পুরান ঢাকায় যানজটের পুরাতন চিত্র
পুরান ঢাকার নয়াবাজার এবং বাবুবাজার ব্রিজ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রচণ্ড যানজট৷নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রাফিক পুলিশ জানান, পুরান ঢাকায় দিনব্যাপী প্রচণ্ড যানজট থাকা নৈমিত্তিক ঘটনা৷ স্বাভাবিক কর্মদিবসে তো বটেই, ছুটির দিনেও যানজট সামলাতে তাদের হিমশিম খেতে হয়৷
কাঁচাবাজারে ভিড়
ঢাকার অন্যতম প্রধান কাঁচাবাজারের মধ্যে মিরপুর ১, কারওয়ান বাজারে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতার যথেষ্ট সমাগম রয়েছে৷ কারো মাঝে নেই স্বাস্থ্যবিধির বালাই৷ অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই, কেনাকাটা করছেন গা ঘেঁষে৷ সাংবাদিকের উপস্থিতি দেখে কেউ কেউ তড়িঘড়ি করে মাস্ক পরলেও বাকিরা ছিলেন নির্বিকার৷
মাস্ক পরায় উদাসীনতা
ছেলের চিকিৎসা করাতে কামরাঙ্গীরচর থেকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে এসেছিলেন মোছা. লিমা খাতুন৷ চিকিৎসাশেষে ফিরে যাওয়ার সময় মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘‘টিভিতে দেখসি ভাইরাসের এহন তেমন একটা মানুষ মরতাসে না৷ তাই এহন আর মাস্ক পরি না৷ আর এই গরমে মাস্ক পইরা থাকাও কঠিন৷’’
স্বাভাবিক হচ্ছে জীবনযাত্রা
ঢাকার অলি-গলির চায়ের দোকান, বিপণিবিতান, ছোট-বড় হোটেল-রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখা যায়, সেখানে সাধারণ মানুষের আনাগোনা বেড়েছে, সেই সাথে বেড়েছে আড্ডা, কেনাকাটা৷ বেশ কয়েকজন ক্রেতা, বিক্রেতা এবং পথচারীর সাথে কথা বলে জানা যায়, লকডাউন তুলে নেওয়া এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিম্নমুখী হওয়ায় মানুষজন এখন কাজে বের হচ্ছেন৷
গণপরিবহণে উপেক্ষিত সরকারি নির্দেশনা
সরকারের পক্ষ থেকে লকডাউন শিথিল করলেও গণপরিবহণে আসনের অতিরিক্ত যাত্রী না নেওয়া এবং জীবাণুনাশক স্প্রে দেওয়ার ব্যাপারে কঠোরভাবে নির্দেশনা প্রদান করা হয়৷ কিন্তু কোথাও এ নির্দেশনা মানতে দেখা গেল না৷ সরেজমিনে গিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্ন পরিবহণের পাশাপাশি খোদ সরকারি পরিবহণ সংস্থা বিআরটিসি’র বাসেও এসব নিয়ম লঙ্ঘনের ব্যত্যয় দেখা গেল না৷
জমে উঠছে ফুটপাথের কেনাকাটা
ঢাকার শ্যামলি, গুলিস্তান, ফার্মগেট এলাকায় ফুটপাথে ব্যবসা করেন এমন একাধিক হকারের সাথে কথা বলে জানা যায়, লকডাউন তোলার পর তাদের স্বস্তি কিছুটা ফিরেছে৷ তবে স্বাভাবিক হতে আরো সময় লাগবে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগ পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না বলেও মন্তব্য করেন অনেকে৷
খুলে দেওয়া হয়েছে বিনোদনকেন্দ্র
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই গত ১৯ আগস্ট থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে বিনোদনকেন্দ্রগুলো৷ ঢাকার শ্যামলির ডিএনসিসি ওয়ান্ডারল্যান্ডের টিকেট বিক্রয় প্রতিনিধি নাজিফা ইসলাম জানান, স্বাভাবিক দিনের চেয়ে বন্ধের দিনে দর্শনার্থী বেশি আসছেন, যদিও করোনা মহামারির আগের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ দর্শনার্থীও হয় না৷
বিয়ের কেনাকাটায় মন্দা
ঢাকার বাটা সিগনালের বিয়ের সামগ্রীর বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ দোকান ক্রেতাশূন্য৷ কেনাবেচা কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে বর-কনে নামক দোকানের স্বত্বাধিকারি মোফাজ্জল হোসেইন বলেন, বিয়ের কেনাকাটার বাজার একদম খারাপ৷ করোনা মহামারির প্রভাবে হাতে টাকা-পয়সা না থাকার কারণে ঘরোয়াভাবেই বিয়ের কাজ সারছেন অধিকাংশ মানুষ৷
বড় মার্কেটে ক্রেতা সমাগম কম
ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স, চাঁদনি চক, নিউ মার্কেটের মতো বড় মার্কেটে ঘুরে দেখা যায় ক্রেতা সমাগম তুলনামূলক কম৷ দোকানের চেয়ে ফুটপাথে বিক্রি বেশি বলে দাবি করেন অনেক দোকানমালিক৷ কারণ জানতে চাইলে বিক্রয়কর্মী শাহাদাত হোসেন বলেন, ফুটপাথের জিনিস আমাদের দোকানের চেয়ে সস্তা৷ যেহেতু মানুষের হাতে পয়সাপাতি নেই, তাই মানুষ সস্তা জিনিস দিয়েই আপাতত প্রয়োজন সারছেন৷
ব্যাংকপাড়ায় বাড়ছে ব্যস্ততা
ঢাকার মতিঝিল, কাকরাইল, কারওয়ান বাজারের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কর্তব্যরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লকডাউনের পর তাদের ব্যস্ততা বহুগুণে বেড়েছে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত যেহেতু প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই খুলে দেওয়া হয়েছে, সেই হিসেবে আর্থিক লেনদেনও বেড়েছে৷
হাসপাতালের এ কেমন চিত্র?
ঢাকার পঙ্গু হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, পিজি হাসপাতালের বহির্বিভাগ এবং প্যাথলজি বিভাগে মানুষজন গাদাগাদি করে অবস্থান করছেন৷ কেন কেউ স্বাস্থ্যবিধি বা নিয়ম মানছেন না জানতে চাইলে কর্তব্যরত এক আনসার সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘‘জায়গার সংকটের কারণে ইচ্ছা থাকলেও নিয়ম মানানো যাচ্ছে না৷ তাছাড়া সাধারণ মানুষ করোনার ব্যাপারে উদাসীন, তাই বারবার সতর্ক করেও লাভ হচ্ছে না৷’’
কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই
লকডাউনের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর ঢাকার বিপণিবিতান, কাঁচাবাজার, গণপরিবহণ ইত্যাদি জায়গা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মানুষের মধ্যে কোনো ধরনের সচেতনতা নেই৷ কেউ মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি৷ অধিকাংশ মানুষেরই মুখে মাস্ক নেই, সামাজিক দূরত্ব রেখে কাজ করার কোনো প্রবণতা নেই৷
আর যেন লকডাউন দেওয়া না হয়
ঢাকার মিরপুর,ফার্মগেট, গুলিস্তানসহ একাধিক জায়গার ব্যবসায়ী এবং খেটে খাওয়া মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, লকডাউনের কবলে তাদের আয় রোজগার শূন্যের কোঠায় প্রায়৷ নিম্ন আয়ের মানুষদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে৷ তারা চাইছেন সরকার যেন সবাইকে টিকার আওতায় আনে এবং লকডাউন আর না দেওয়া হয়৷