1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রোহিঙ্গা ক্যাম্প: দেখা থেকে লেখা

ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম মূলত রাজনীতি, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, শরণার্থী এবং অভিবাসন সম্পর্কিত ইস্যু কভার করেন৷ পাশাপাশি জার্মানি ও ইউরোপে জীবনযাপনের নানা দিকও তুলে ধরেন তিনি৷
আরাফাতুল ইসলাম
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

মিয়ানমার থেকে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দু'বছর আগে আশ্রয় দিয়ে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে বাংলাদেশ৷ আন্তর্জাতিক সমাজের কাছ দেশটির এই মানবিকতা ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে৷ তবে, দু'বছরের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে গেছে অনেকটাই৷

https://p.dw.com/p/3PWuj
Rohingya-Flüchtlinge in Bangladesch hoffen auf Rückkehr nach Myanmar
নদীর একপাশে টেকনাফ শরণার্থী শিবির, অন্যপাশে রাখাইন রাজ্যছবি: DW/Arafatul Islam

মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ঘটনা নতুন নয়৷ সেই সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে নানা সময় রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন৷ এদের একটি অংশ ফিরেও গেছেন৷ তবে ২০১৭ সালে একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক, সাতলাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেন৷

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশের টেকনাফ, উখিয়ার দূরত্ব বেশি নয়৷ মাঝখানে বড় বাধা বলতে নাফ নদী৷ তাই সীমান্ত পেরিয়ে সহজেই ঢুকে যাওয়া যায় বাংলাদেশে৷ গত চার দশকে তাই ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে৷ 

রোহিঙ্গাদের প্রাণভয়ে পালিয়ে আসার কারণ আমরা যতটা জানি তা হচ্ছে, মিয়ানমার তাদের সেদেশের নাগরিক মনে করে না৷ দেশটির চোখে তারা হচ্ছে বাঙালি৷ আর রাখাইনের অন্য ধর্মের বাসিন্দাদের সঙ্গেও রয়েছে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ বিরোধ৷ সেই বিরোধে রাষ্ট্র যখন অন্যদের পক্ষ নেয় তখন অবস্থাটা হয়ে পড়ে আরো শোচনীয়৷

বলছি না, রোহিঙ্গারা একেবারে ধোয়া তুলসি পাতা৷ তাদের মধ্যে এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদ বা সন্ত্রাসমূলক অপরাধে জড়ানোরও নজির আছে৷ রাখাইনে তাদের বিরুদ্ধে সেইসব অভিযোগ আর অপরাধ পুঁজি করে দেশটির সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে৷ সেই অভিযানে অসংখ্য রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন অনেক রোহিঙ্গা নারী আর তাদের কিছু গ্রাম একেবারে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে৷

এরকম এক পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশের সীমান্তে ভিড় করে, তখন এক পর্যায়ে বাংলাদেশ তাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়৷ ফলে কুতুপালং এবং নয়াপাড়ায় আগে থেকে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছাকাছি নতুন পলাতকেরা আশ্রয় নিতে শুরু করে৷ মনে আছে, সেসময় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার পক্ষে মিছিলও হয়েছিল বাংলাদেশে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেক মানুষ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন৷

এটা সত্য যে নতুন রোহিঙ্গাদের টেকনাফ এবং উখিয়ায় আশ্রয় দিতে গিয়ে সেখানকার বনভূমি উজাড় করা হয়েছে, যেখানে আগে অসংখ্য হাতির বিচরণ ছিল৷ মনে আছে পরিবেশের এই ক্ষতি নিয়ে বাংলাদেশের তৎকালীন বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে প্রশ্ন করেছিলাম৷ তখন তিনি বলেছিলেন, ‘‘পরিবেশের ক্ষতিতো হবে৷ কিন্তু মানুষের উপরেতো কেউ নেই, মানবতার উপরেতো কেউ নেই৷''

কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়াতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নানাবিধ সহায়তা দিতে অনেক দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থা দ্রুত সেখানে গেছে৷ জাতিসংঘের বিভিন্ন উন্নয়নসংস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্রাক সেখানে নানা প্রকল্প পরিচালনা করছে৷ আর সেসব প্রকল্পের জন্য অর্থ সহায়তা করেছে, করছে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং দেশ৷

তবে, দেশি-বিদেশি সহায়তা যাই থাক না কেন, ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে যে উদারতার পরিচয় দিয়েছে, সেটা বাংলাদেশিদের জন্য, বিশেষ করে প্রবাসীদের জন্য অনেক গর্বের ব্যাপার৷ 

রোহিঙ্গারা পতিতাবৃত্তিতে জড়াচ্ছেন কেন?

সমস্যা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাদেশের এই উদারতার ভূয়সী প্রশংসা হলেও যে দেশের কারণে এই সংকটের সৃষ্টি, সেই মিয়ানমারের উপর গত দুই বছরে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তেমন একটা চাপ সৃষ্টি হয়নি৷ বরং দেশটি এই সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের কিছু গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে সেখানে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প, সরকারি ভবন তৈরিসহ অন্যদের আশ্রয় দিয়েছে৷ দেশটি কার্যত রোহিঙ্গাদের সত্যিকার অর্থে ফেরত নিতে চায় এমন কোন কিছু করেনি৷

ফলে, বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের ভীতি সৃষ্টি হয়েছে যে রোহিঙ্গারা সম্ভবত স্থায়ীভাবেই বাংলাদেশে থেকে যাবে৷ গতমাসে কিছুদিন দুই জার্মান সহকর্মীসহ শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে, স্থানীয় প্রশাসন, সরকারের নানা পর্যায়ের সঙ্গে কথা বলে আমার কাছে এটাই মনে হয়েছে যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একধরনের ভীতি দানা বাঁধছে৷ আর এই ভীতিতে নানাভাবে রসদ জোগাচ্ছে কিছু গণমাধ্যম এবং ফেসবুক৷

দিনে এবং রাতে শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে আমি দেখেছি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা অত্যন্ত কঠোরভাবে সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখছে৷ গতমাসে সেখানে স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ইতোমধ্যে অন্তত পাঁচ রোহিঙ্গা ‘ক্রসফায়ারে' নিহত হয়েছেন৷ রোহিঙ্গা নারীদের পতিতাবৃত্তিতে জড়ানো ঠেকাতে টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজারে বিভিন্ন হোটেলে নিয়মিতই পুলিশ রেইড চলছে৷ অবস্থা এমন যে যৌনকর্মীদের অনেকক্ষেত্রে হোটেলে না রেখে বিচে কিংবা অটোরিকশায় রাখা হচ্ছে এবং দালালরা নানাভাবে খদ্দেরদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে৷

নিরাপত্তা বাহিনীর এই সক্রিয়তার মাঝেও ছোটখাট নানা ধরনের অপরাধ ঘটছে, ঘটছে মানবপাচারের ঘটনা৷ কিন্তু সেসব অপরাধের কোনটাই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে কিংবা কক্সবাজার ‘দখল করে নেয়ার' পায়তারা নয়৷ রোহিঙ্গাদের সেই সাধ্য, স্বপ্ন কোনটাই নেই৷ অথচ ফেসবুকে মাঝেমাঝেই দেখি অনেকে সেরকম ইঙ্গিত দিচ্ছেন৷

গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের এক বড় সমাবেশ নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে৷ কেউ কেউ এটাকে বাংলাদেশের জন্য হুমকি মনে করছেন৷ অথচ সেই সমাবেশ থেকে কার্যত বাংলাদেশের মানুষের জন্য দোয়া চাওয়া হয়েছে এবং রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকার কোনো কোনো দাবি মানলে তারা ফিরে যাবে সেটা শক্তভাবে জানিয়েছে৷ মোটের উপর সমাবেশটা রোহিঙ্গারা করেছিল স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সায় পেয়েই৷ সায় পাওয়ার বিষয়টি আমি নিশ্চিতভাবে বলছি এজন্য যে আমরা সেই সমাবেশের আগে রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়েছি৷ সেখানে কর্মরত মানবাধিকার কর্মী, এনজিও এবং স্থানীয় রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন শুধুমাত্র প্রশাসনের অনুমতি পেলেই সমাবেশটি হতে পারে৷

অথচ সরকারের তরফ থেকে সমাবেশের পর বেশ কিছু উদ্যোগ দেখা গেছে৷ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি)  এবং একটি ক্যাম্পের ইনচার্জকে রাতারাতি অন্যত্র বদলি করা হয়েছে৷ রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে যাদের চিহ্নিত করা গেছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে৷ আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যে সমাবেশ আগেই বন্ধ করা যেতো সেটাকে হতে দিয়ে পরবর্তীতে তা নিয়ে এত কথা কেন? 

Arafatul Islam Kommentarbild App
আরাফাতুল ইসলাম, ডয়চে ভেলে

শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে মোটা দাগে আমার কাছে মনে হয়েছে অধিকাংশ রোহিঙ্গাই মিয়ানমারে তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে চান৷ তারা শুধু চান, মিয়ানমার সরকার তাদেরকে নিজের দেশের মানুষ হিসেবে মেনে নিক এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক৷ আর এই নিশ্চয়তা মিয়ানমারের কাছ থেকে আদায় করে নেয়ার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক সমাজের৷ তাই এক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো উচিত৷

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ৷ এই দেশের অনেক মানুষ এখনো উপযুক্ত চাকরি পাচ্ছেন না, তিন বেলা খেতে পারছেন না৷ এরকম একটি দেশের মানুষ যখন দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের মুখে শোনে রোহিঙ্গারা অনেক ‘আরাম-আয়েশে' আছেন, তখন স্বাভাবিকভাবে তাদের অনেকের পক্ষে সেটা মেনে নেয়া কঠিন৷ এটা ঠিক, রোহিঙ্গারা রাখাইনে যে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, সেই তুলনায় কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পের অস্থায়ী তাঁবুতে ভালো আছেন৷ তবে, সেই ভালো থাকা আরাম-আয়েশের পর্যায়ে পড়ে না৷

আমার মনে হয়, বর্তমান পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে বাড়তি ভীতি তৈরির চেয়ে তাদের ফিরিয়ে নিতে কূটনৈতিক তৎপরতায় জোর দেয়া উচিত৷ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের কাছে বোঝা হতেই পারে, কিন্তু সেই বোঝা ঠান্ডা মাথায় সরাতে হবে৷ সাধারণ মানুষের মধ্যে অহেতুক ভীতি, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা তৈরি করে কোন সমাধান আসবে না৷

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন এখানে৷