‘কর্পোরেট অনুদানের' দরজা খুলে গেল
৩ এপ্রিল ২০১৭নতুন আইনে দলগুলোর ‘বেনামি তহবিল' আরও মজবুত হবে বলেই মনে করা হচ্ছে৷ ‘‘এ দেশে ভাষণ দেওয়া এবং সম্পাদকীয় লেখার কাজটা সহজ৷ কিন্তু, বিকল্প ভালো প্রস্তাব দেওয়াটা খুবই কঠিন'' — দেশের সংসদে দাঁড়িয়ে কথাগুলো যিনি বলছিলেন, তিনি ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি৷ আসলে বিগত কিছুদিন ধরে দেশের প্রায় সমস্ত জাতীয় সংবাদপত্রে সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা দেওয়ার আইনি দরজা হাট করে খুলে দেওয়ার সমালোচনা করা হচ্ছিল৷
রাজনৈতিক দলের তহবিল মজবুত করতে ‘নির্বাচনী বন্ড' পদ্ধতি চালু করার পরিকল্পনা সরকারের৷ এই পদ্ধতিতে দলের তহবিলে মোটা টাকা ঢুকলেও কে বা কারা ওই টাকা দিয়েছে, তা জানাতে বাধ্য থাকবে না দলগুলি৷ একই অধিকার পাবে দাতা কর্পোরেট সংস্থাগুলিও৷ দেশের বহু সংবাদপত্রে সম্পাদকয়ীয় লিখে নিন্দা করা হয়েছে৷ সেই প্রসঙ্গেই দেশের অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্য৷ উল্টে ভারতে রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে অনুদান দেওয়া নিয়ে ভারত সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তার ফলে রাজনীতিতে কালো টাকার প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত হবে বলে দাবি করলেন জেটলি৷ তিনি জানিয়েছেন, ‘‘বন্ডের মাধ্যমে অনুদান নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা অস্বচ্ছতা আছে ঠিকই, কিন্তু এর থেকে ভালো কোনও প্রস্তাব তাঁর কাছে নেই৷''
অর্থমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ, যদি কেউ গ্রহনযোগ্য কোনও প্রস্তাব দিতে পারেন, তাহলে তিনি অবশ্যই তা গ্রহণ করার কথা ভাববেন৷ আসলে এই প্রশ্নটা এসেছিল, অর্থ বিলের ওপর রাজ্যসভার করা পাঁচটি সংশোধনী নিয়ে৷ ৩০ মার্চ লোকসভায় সব সংশোধনী খারিজ হয়ে গেছে৷ অর্থবিলে এবার জনপ্রতিনিধি আইনের সংশোধনও করেছে মোদী সরকার৷ তাতে বলা হয়েছে, আগে কোনও কর্পোরেট তাদের লাভের মাত্র সাড়ে সাত শতাংশ অর্থ রাজনৈতিক দলকে দিতে পারত৷
এখন আর কোনও উর্ধ্বসীমা থাকবে না৷ তাছাড়া বাজেটে প্রস্তাবিত বন্ড কিনে রাজনৈতিক দলগুলিকে কোনও কোম্পানি অর্থ সাহায্য করলে তাদের জানাতে হবে না যে, কোন দলকে তারা অর্থ দিয়েছে৷ এর ওপর রাজ্যসভার সংশোধনী ছিল, আগের ব্যবস্থা বহাল থাক৷ সাড়ে সাত শতাংশের বেশি লাভের টাকা রাজনৈতিক দলে দেওয়া যাবে না৷ আর কোন রাজনৈতিক দলকে কত টাকা দেওয়া হচ্ছে, তা জানাতে হবে৷
লোকসভায় কংগ্রেস, বাম, তৃণমূল, বিজেডি ছাড়া সরকারের শরিক দল শিবসেনাও এই সংশোধনকে সমর্থন করে৷ কিন্তু, শেষ পর্যন্ত সরকার তা মানেনি৷ এই সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে জেটলির যুক্তি হলো, ‘‘নাম প্রকাশ করার বিষয়টি থাকলে কর্পোরেটগুলি পিছিয়ে যাবে, কারণ, তাদের একটা আশঙ্কা থাকে সরকার বদল হলে তাদের হেনস্থার মুখে পড়তে হতে পারে৷ এই আশঙ্কার জন্যই আগের ব্যবস্থা সফল হয়নি৷ সে জন্যই এবার নাম জানানোর বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি৷ এতে রাজনৈতিক দলগুলির কাছে কালো টাকা আসবে না৷ তবে এতেও পুরো স্বচ্ছতা আসবে না৷''
অর্থমন্ত্রী জেটলি বলেন, ‘‘কংগ্রেসের যদি এতে আপত্তি থাকে তো তারা কর্পোরেটের কাছ থেকে শুধু চেক -এ টাকা নিক৷'' কংগ্রেসের দীপেন্দর হুডা, বিজেডি-র ভর্তৃহরি মহাতব, তৃণমূলের সৌগত রায়, শিবসেনার আনন্দরাও আদসুল অবশ্য মনে করেন, ‘‘এতে রাজনৈতিক অনুদানে অস্বচ্ছতা আরও বাড়বে৷''
তৃণমূলের বোলপুরের সাংসদ ড. অনুপম হাজরা মনে করছেন, সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে বিপুল জয়ের পর ‘ধরাকে সরা জ্ঞান' করছে বিজেপি৷ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিরোধীদের যাবতীয় আপত্তিকে উপেক্ষা করে ‘অর্থ বিল'-এর মাধ্যমে একসঙ্গে ৪০টি আইনে সংশোধনী পাশ করিয়ে নেয় কেন্দ্র সরকার৷ এর মধ্যে যেমন রাজনৈতিক দলের অনুদানের বিষয়টি রয়েছে, তেমনি রয়েছে আয়কর আধিকারিকদের অভিযান চালানোর বিষয়টিও৷ তাঁর আশঙ্কা, ‘‘এতদিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই-কে কাজে লাগিয়ে বিরোধীদের হেনস্থা করা হয়ে এসেছে৷ অভিযোগ প্রমানিত হওয়ার আগেই সিবিআই হেফাজতে রেখে মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু, যাঁদের বিরুদ্ধে কোনও দুর্নীতির প্রাথমিক অভিযোগ নেই, তাঁদের জব্দ করতে আয়কর বিভাগের এই নতুন আইনকে হাতিয়ার করবে মোদী সরকার৷''
আয়কর দপ্তরের অভিযান-সংক্রান্ত নতুন কিছু প্রস্তাব আইনে রূপান্তরিত হয়েছে৷ যেমন, আয়কর দপ্তরের বিবেচনায় যদি কোনও ব্যক্তির বাড়ি অথবা দপ্তরে তল্লাশি চালানো প্রয়োজন মনে হয়, তাহলে সেই ব্যক্তিকে কিছু না জানিয়েই তার বাড়িতে তল্লাশি চালানো হতে পারে৷ হিসেব বহির্ভুত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হতে পারে এবং তাকে আটক করা হতে পারে৷ পুরো বিষয়টি নির্ভর করবে আয়কর দপ্তরের বিবেচনার ওপর৷
তবে, অর্থমন্ত্রী জেটলি বলেছেন, ‘‘আয়কর হানা নিয়ে বিরোধীদের আশঙ্কা ঠিক নয়৷'' বিরোধীরা বলেছিলেন, সরকার এখন নিয়ম বদল করে এমন ব্যবস্থা করেছে, যাতে আয়কর অফিসাররা ইচ্ছে করলেই যে কোনও লোকের বাড়িতে হানা দিতে পারে এবং তল্লাশি চালাতে পারে৷ জেটলি জানান, ‘‘এটা একেবারেই ভুল ধারণা৷ আগের ব্যবস্থাই বহাল থাকছে৷ কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার বাপারে কোনও সন্দেহ হলে বা খবর এলে, প্রথমে রিপোর্ট তৈরি হয়৷ তারপর উঁচু পদে থাকা অফিসারের অনুমতিক্রমে হানা হয়৷ আগেও এই ব্যবস্থা ছিল৷ এখনও তাই থাকবে৷ আদালতের একটা রায়ের পর বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল, সেটা কাটাতেই নতুন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷''
অর্থমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘‘এর আগে একাধিকবার এই বিষয়ে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা হয়েছে৷ কিন্তু, তা সত্ত্বেও দেশে কোথাও কোনও স্বচ্ছতা নেই, স্বচ্ছ টাকাও নেই৷ নির্বাচনে প্রার্থীরা কেউই জানান না তিনি কার কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছেন৷ ২০০১ সালে বিজেপি সরকার এই বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিল৷ তখন কংগ্রেস সমর্থন করেছিল৷ ২০১১-তে কংগ্রেস নিয়ম এনেছিল৷ তখন বিজেপি সমর্থন করেছিল৷''
প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগেই এই অর্থবিলে মোট ৫টি সংশোধনী এনেছিল রাজ্যসভা৷ সেখানে বিরোধীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ লোকসভায় বিল পাশ হওয়ার আগে রাজ্যসভার সঙ্গে সহমত পোষন করে বিশেষত দুটি বিষয়ে ঘোরতর আপত্তি তুলেছিল বিরোধধীরা৷ প্রথমটি হলো, আয়কর আইনে সংশোধনী এনে বলা হয়েছে, এবার থেকে আয়কর দপ্তরের আধিকারিকরা যখনতখন সন্দেহভাজন কারও বাড়ি অথবা অফিসে অভিযান চালাতে পারবেন৷
অভিযানকারীরা প্রয়োজন মনে করলেই সেই ব্যক্তিকে আটক করতে পারবেন এবং হিসাব বহির্ভুত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবেন৷ রাজ্যসভায় বিরোধীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় সংশোধনী হিসেবে বিলের এই অংশটি বিলুপ্ত করার প্রস্তাব গৃহিত হয় সেখানে৷ দ্বিতীয়টি হলো, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে সংশোধনী এনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলি এবার থেকে দলীয় চাঁদা হিসেবে ব্যাঙ্কচেক, নগদ, অনলাইন এবং নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে টাকা নিতে পারবে৷ সেক্ষেত্রে ওই রাজনৈতিক দল অথবা সংস্থা কেউই এই লেনদেনের বিবরণ প্রকাশ্যে আনতে বাধ্য নয়৷
এতদিন কর্পোরেট সংস্থাগুলি তাদের বার্ষিক লভ্যাংশের ৭.৫ শতাংশ কোনও রাজনৈতিক দলকে চাঁদা হিসেবে দিতে পারত এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আয়-ব্যায়ের হিসেবের মধ্যে কোন রাজনৈতিক দলকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে তার উল্লেখ থাকত৷ ফিনান্স বিলে কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার উর্ধ্বসীমা বিলুপ্ত করার পাশাপাশি কর্পোরেট ও রাজনৈতিক দল উভয়কেই বিষয়টি গোপন রাখার অধিকার দেওয়া হয়েছে৷ এখানেই আপত্তি তুলেছিল রাজ্যসভা৷ লোকসভায় শাসক দল বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় বিরোধীদের সংশোধনীগুলির সবকটিই খারিজ হয়ে যায়৷
‘‘রাজ্যসভার একটিও সংশোধনী মানা সম্ভব নয়''- এই মন্তব্য করে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেন, ‘‘ভারতে রাজনৈতিক দল চালাতে গেলে যে টাকার প্রয়োজন, তা নিয়ে কারও মনে সংশয় নেই৷ তাহলে যতটা সম্ভব স্বচ্ছতা রেখে টাকা লেনদেন করা উচিত৷ কিন্তু, কোন বানিজ্যিক সংস্থা কোন রাজনৈতিক দলকে কত টাকা দিচ্ছে, তা জনসমক্ষে আসার ফলে একদিকে যেমন সেই সংস্থাকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, ঠিক তেমনি রাজৈতিক দলকেও বিপদে পড়তে হচ্ছে৷ তাই টাকা নেওয়ার ৪টি পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে৷ ব্যাঙ্কচেক, নগদ (সর্বোচ্চ দু-হাজার), অনলাইল এবং বন্ড৷ বিরোধীদের কোনও দল যদি সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রাখতে চায়, তাহলে এরমধ্যে যেকোনও একটি বেছে নিতেই পারে৷ চেকে টাকা নিলে সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছতা বজায় থাকে৷ বন্ডের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হলে যে সংস্থা টাকা দিচ্ছে তারা তাদের বার্ষিক আয়-ব্যায়ের হিসেবে শুধুমাত্র ‘নির্বাচনী বন্ড' বাবদ কত টাকা খরচ করেছে তার হিসেব দেবে৷''