যেভাবে বাংলাদেশের পাশে জার্মানি

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সাথে জার্মানির সুসম্পর্কের সূচনা৷ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে স্বিকৃতি দেয়া ইউরোপের প্রথম দিকের দেশগুলোর একটি জার্মানি৷ দুই জার্মানির একত্রিকরণকে স্বাগত জানাতে দেরি করেনি বাংলাদেশও৷ দেশটির বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও চার্চ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো স্থানীয় অংশীদারদের মাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখছে৷ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগী হিসেবেও৷

যুক্তরাষ্ট্রের পরই বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি বাজার জার্মানি৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে তারা ৪২৮ কোটি ডলারের পণ্য কিনেছে, যার মধ্যে ৪০০ কোটি ডলারই ছিল তৈরি পোশাক৷ ৮.৩ কোটি ডলারের চামড়াজাত পণ্য, ৭.২ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্যও রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ৷ অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে জার্মানি আমদানি করেছে প্রায় ৮২ কোটি ডলারের পণ্য, যার অর্ধেকই ছিল মেশিনারি বা যন্ত্রপাতি৷

১৯৭০ এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন প্রকল্পে বাংলাদেশেকে ৩০০ কোটি ইউরোর আর্থিক সহায়তা করেছে জার্মানি৷ সবশেষ গত নভেম্বরে ঢাকায় দুই দেশের সরকারি প্রতিনিধিদের মধ্যে এক বৈঠকে ২৮.৫৩ কোটি ডলার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি আসে জার্মানির কাছ থেকে৷ যা ব্যয় হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও নগরে জলবায়ু মোকাবেলায় বিভিন্ন প্রকল্পে৷

দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ দৃঢ় করতে ১৯৬১ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় জার্মান ভাষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গোয়েটে ইনস্টিটিউট৷ প্রতি বছর ১৫০০ শিক্ষার্থী এখান থেকে জার্মান ভাষা শিখছে৷ আছে জার্মান সাহিত্য, ইতিহাস ও রাজনীতির সাথে পরিচিত হবার ব্যবস্থাও৷ জার্মান চলচ্চিত্র, সংগীত ও সাহিত্য নিয়ে উৎসবের আয়োজনও করে থাকে গোয়েটে৷

জার্মান অ্যকাডেমিক এক্সচেইঞ্জ সার্ভিস (ডিএএডি), আলেক্সান্ডার ফন হুমবল্ট ফাউন্ডেশন, ডয়চে ভেলেসহ বিভিন্ন জার্মান প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের শিক্ষা ও গণমাধ্যমের উন্নয়নে অবদান রেখে চলছে৷ প্রতিবছর বাংলাদেশের শিক্ষার্থী, তরুণ বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদদের তারা বিভিন্ন বৃত্তি দিয়ে থাকে৷ বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০০ ছাত্র-ছাত্রী জার্মানির উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি রয়েছে৷

ফেডারেল মিনিস্ট্রি অফ ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট বা বিএমজেড-এর অধীনে রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য ১৫ লাখ ইউরো সহযোগিতা দিয়েছিল জার্মানি৷ তৈরি পোশাক কারখানার সংস্কার উদ্যোগেও পাশে আছে দেশটি৷ ২০০৫ সাল থেকেই বাংলাদেশের শিল্প কারখানায় সামাজিক ও পরিবেশগত মানদণ্ড নিশ্চিত করতে সহযোগিতা দিচ্ছে তারা৷ আছে ভবিষ্যত প্রতিশ্রুতিও৷

মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা সহ বিভিন্ন প্রকল্পে সহযোগিতা দিয়ে আসছে জার্মানি৷ এই খাতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশটি প্রায় ৬.৭ কোটি ইউরো খরচ করেছে৷ পরবর্তীতে আরো ৩ কোটি ইউরো সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জার্মানি৷

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ জ্বালানি প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে দীর্ঘদিন ধরে জার্মান প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে৷ পঞ্চগড়ে ৪৭ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগড়ে উঠেছে জার্মান দু’টি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায়৷ দেশটির কালি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিজবের্ক বাংলাদেশে তাদের কারখানা চালুর ঘোষণা দিয়েছে৷

বাংলাদেশে এযাবতকালের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে জার্মানির প্রতিষ্ঠান সিমেন্স৷ পায়রায় ৮০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তে ৭০০ কোটি ইউরো খরচ করবে তারা৷ যার অংশ হিসেবে ফেব্রুয়ারিতে ৩৬০০ মেগাওয়াটের এলএনজি পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের চুক্তি করে প্রতিষ্ঠানটি৷ বাংলাদেশের টেক্সটাইল, যোগাযোগ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে৷

বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট তৈরি করে দেয়ার কাজ পেয়েছে জার্মান প্রতিষ্ঠান ফেরিডোস৷ ৩৪ কোটি ইউরোর এই প্রকল্প শেষ হবে ১২ বছরে৷ ২০১৮ সালের জুলাইতে দুই দেশের সরকারের মধ্যে এবিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷ সে অনুযায়ী জার্মান প্রতিষ্ঠানটি চলতি বছরের জুনেই প্রথম পর্যায়ের ই-পাসপোর্ট সরবরাহের কথা রয়েছে৷ বিশ্বে প্রযুক্তিগতভাবে জার্মানির পর বাংলাদেশই এত শক্তিশালী পাসপোর্টের অধিকারী হবে, যা জাল করা প্রায় অসম্ভব৷

এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি বাংলাদেশকে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য একটি মডেল অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছে৷ তাদের গবেষণা অনুযায়ী অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই আর দৃঢ় অর্থনীতি গড়ে তুলতে বাংলাদেশের সামনে জার্মানিই হতে পারে সম্ভাব্য মডেল৷ কেননা এসএমই খাতের বিকাশ, শিল্পভিত্তিক উন্নয়ন আর জনসংখ্যার বিকেন্দ্রিকরণের পাশাপাশি দেশটি তার সব এলাকায় সমানভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করেছে৷