বই পোড়ানোর ঐতিহাসিক দিন
১০ মে ২০১৩ট্রাক ও ট্রলিতে করে ছাত্ররা ২০,০০০-এর বেশি বই পোড়ানোর জন্য ঐ জায়গায় নিয়ে এসেছিলেন৷ এগুলির মধ্যে ছিল হাইনরিশ মান, এরিখ মারিয়া রেমার্ক, ইওয়াখিম রিংগেলনাৎস-এর মতো প্রসিদ্ধ লেখকের গ্রন্থও৷ নাৎসিদের ছাত্র নেতা হ্যার্বার্ট গুটইয়ার ঘৃণাভরা এক বক্তব্য রাখেন এই ধ্বংসযজ্ঞ উপলক্ষ্যে৷ ‘‘আমরা যা কিছু অ-জার্মান, তা আগুনে বিসর্জন দিচ্ছি৷''
তার সামনে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলছিল তখন৷ পুড়ছিল অনেক বই৷ ২৩ বছর বয়সি হ্যার্বাটও এক বান্ডিল বই আগুনে ফেলেন৷
সারা জার্মানি জুড়েই এই ধরনের দৃশ্য দেখা গেছে সেই কালো দিবসে৷ বিশ্ববিদ্যালয় শহরগুলিতে ছাত্ররা দলে দলে বের হয়ে আসেন৷ সাথে স্তূপ করা বইয়ের বান্ডিল৷ কয়েক সপ্তাহ ধরেই বিভিন্ন গ্রন্থাগার থেকে বেছে বেছে বই বের করে পোড়ানোর ব্যবস্থা করেন তারা৷ তাদের মতে, এগুলি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের চিন্তাধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও অ-জার্মান৷ তাই এগুলিকে বাতিল করতে হবে৷
এর মধ্যে বিশেষ করে স্থান পেয়েছিল কমিউনিস্ট ও ইহুদি লেখকদের বই৷ লাইব্রেরির কর্মচারি এবং অনেক অধ্যাপকও তাদের এই চৌর্যবৃত্তিতে বাধা দেয় নি৷
১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিকরা ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর হিটলারের অধীনে জার্মানিতে শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান৷ এরপর ছাত্র সংগঠনগুলিও যোগ দেয় তাতে৷ নাৎসিদের ছাত্র সংগঠন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক ছাত্রসংঘ অগ্রণীর ভূমিকা পালন করে এক্ষেত্রে৷ ১৯৩৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে ‘অ-জার্মান ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে কর্মসূচি' নামে একটি ক্যাম্পেন চালাতে থাকে দলটি৷ আর এই কর্মসূচি চরম পরিণতি পায় ১০ই মে৷
রেডিওর মাধ্যমে কর্মসূচিটি প্রচার করা হয়৷ ছাত্ররা দলে দলে নাৎসিদের এসএস বাহিনীর ইউনিফর্ম পরে বাইরে চলে আসেন৷ সাথে বেছে বেছে আনা বই ৷ ‘আমি হাইনরিশ মান, এর্নসট গ্ল্যাসার, এরিখ কেস্টনারের বইগুলি তুলে দিচ্ছি আগুনে' এই বুলি আওড়ে আগুনে ফেলে দেন তারা সেগুলি৷
‘এমিল ও গোয়েন্দা বাহিনী'-র লেখক আন্তর্জাতিক খ্যাত এরিখ কেস্টনার বার্লিনের অপেরা চত্বরে স্বচক্ষে দেখেছেন এই ভয়ানক দৃশ্য৷ পরে তিনি লেখেন, ‘‘এটা ছিল অত্যন্ত ন্যক্কারজনক এক ঘটনা৷ ইউনিভার্সিটির অনেক প্রফেসরও সেখানে উপস্থিত ছিলেন৷''
মধ্যরাতের দিকে সেই চত্বরে উপস্থিত হন ইয়োসেফ গোয়েবেলস৷ হিটলারের প্রচারণা মন্ত্রী৷ ডক্টরেট ডিগ্রিধারী৷ সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেন তিনি৷ ‘‘জার্মান পুরুষ ও নারীরা, ইহুদিদের অতিরঞ্জিত বুদ্ধিবাদের অবসান ঘটলো এবার৷''
বহির্বিশে অত্যন্ত ভীতির সঙ্গে লক্ষ্য করা হয় বই পোড়ানোর ঘটনাটিকে৷ হয় নিন্দনীয়৷ অ্যামেরিকার ম্যাগাজিন নিউজউইকে লেখা হয়, ‘হলোকস্ট অব বুক''৷ এই ঘটনার মাত্র কয়েক বছর পর নাৎসিদের ইহুদি নিধন যজ্ঞ পর্ব শুরু হয়৷ যা হলোকাস্ট নামে পরিচিত৷
১৯৩৩ সালে শিল্পী ও সাহিত্যিকরা দলে দলে জার্মানি ত্যাগ করতে শুরু করেন৷ বিদেশে কবি ও দার্শনিকের দেশ বলে পরিচিত জার্মানি এইভাবে মেধাশূন্য হতে থাকে৷ বিশেষ করে ইহুদি লেখক বুদ্ধিজীবীরাই দেশ ত্যাগ করেন৷ তবে নির্বাসনে থেকেও অনেকে নাৎসিদের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাতে থাকেন৷ যাঁরা বিদেশে যেতে পারেননি, তাঁদের বইপত্র প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়৷ এক্ষেত্রে এরিখ কেস্টনারের নাম করা যায়৷ ১৯৩৪ সালে ৩,০০০ বই-এর ওপর সেন্সর জারি করা হয়৷
তবে দুঃখের বিষয়, জার্মানদের একটা বড় অংশই বই পোড়ানো ও সেন্সরকে মুখ বুজে মেনে নিয়েছিলেন৷ যাদের মধ্যে অনেক বুদ্ধিজীবী ও অধ্যাপকও ছিলেন৷ অনেকে স্বাগতও জানিয়েছেন এই ঘটনাকে৷ আর শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত ছাত্রসমাজ যে উৎসাহ উদ্দীপনার নিয়েএই ঘৃণ্য কাজটি করেছে তা অত্যন্ত বেদনাবহ৷