যুগে যুগে জার্মান ক্রিসমাস
গত কয়েক দশকে জার্মানিতে বড়দিনের উদযাপন বেশ বদলে গেছে৷ ছবিঘরে দেখুন এই পরিবর্তনের কিছু চিত্র৷
প্রিয় ক্রিসমাস ট্রি
জার্মানদের বসার ঘরে এখন লাখ লাখ ক্রিসমাস ট্রি শোভা পায়৷ আগে সাধারণ গাছই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু এখন বেশিরভাগ গ্রাহকই উন্নতমানের এবং দামি গাছ খোঁজেন। শুধু তাই নয়, মোমবাতি, তারা, ছোট ছোট মূর্তি - সাজসজ্জার কোনও সীমা নেই। ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুশোভিত গাছ দেখে শুধু বাচ্চাদের নয়, বড়দের চোখও আনন্দে ভরে ওঠে।
১৯৪৫ সালে ক্রিসমাস
বিধ্বংসী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম ক্রিসমাস ১৯৪৫ সালে৷ জার্মানি পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে৷ হাজার হাজার শরণার্থী এবং গৃহহীন মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাস্তায়৷ জার্মানিতে অবস্থানরত অ্যামেরিকান সেনারাও জার্মান জনগণের মধ্যে তখন উদাসীন মনোভাবের কথা উল্লেখ করেছিলেন৷ বেশিরভাগ মানুষের মনে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি ছিল, খাবার পাওয়া যাবে কোথায়?
যুদ্ধে পর বিধ্বস্ত দেশ
১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ক্রিসমাসে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা অনাহারে থাকা দরিদ্র শিশুদের মধ্যে উপহার, চকলেট এবং মিষ্টি বিতরণ করে। খাবার ও আবাসনের অভাব মানুষকে একে অপরের কাছে টেনে এনেছিল৷ অনেকে মিলে খাবার ভাগাভাগি করে একসঙ্গে ক্রিসমাস উদযাপন করার চেষ্টা করতেন। পুরানো খেলনা বা পোশাক আদানপ্রদান করা হতো কম দামি উপহার হিসেবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন
১৯৫০ এর দশকে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে৷ এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রিসমাসেও লাগে রঙ৷ কিন্তু তখনও কেবল অতি প্রয়োজনীয় জিনিসের প্রতিই মানুষের আগ্রহ ছিল৷ জামা-কাপড়, বিছানার চাদর, রান্নার পাত্রই ছিল উপহারের জিনিস৷ তবে শিশুরা এসময় থেকে নতুন খেলনা উপহার হিসেবে পেতে থাকে৷ পশ্চিম জার্মানি এসময় পূর্ব জার্মানির চেয়ে অনেক স্বচ্ছল ছিল৷
‘ধর্মমুক্ত’ ক্রিসমাস
১৯৫০ এর দশকে সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানি নিজেদের সমাজতান্ত্রিক নীতির সঙ্গে বড়দিন উদযাপন সাংঘর্ষিক বলে মনে করে৷ ফলে সেসময় ক্রিসমাসের ছুটি থাকলেও সেটিকে ধর্মের বাইরে গিয়ে শান্তির উৎসব হিসেবে পালন করা হতো৷
পূর্ব জার্মানির রপ্তানি
১৯৬০ এর দশকে তৎকালীন পূর্ব জার্মানি ক্রিসমাসের সময় ডাকটিকেট উন্মোচন করতো৷ কিন্তু তাতে ধর্মীয় সব অনুসঙ্গ বাদ দিয়ে লোকশিল্প ফুটিয়ে তোলা হতো৷ তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার ওরে পর্বতমালার কাঠের তৈরি ঐতিহ্যবাহী নকশা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পশ্চিম জার্মানিতেও। ক্রিসমাসের সময় জুড়ে এসব কারু পণ্য দ্রুতই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির সেরা রপ্তানি পণ্যে পরিণত হয়।
ভোগবাদে ঝুঁকলো পশ্চিম
৬০ এর দশকে যুদ্ধ-পরবর্তী পশ্চিম জার্মানি পুনর্নির্মাণ হয়ে এসেছে৷ দেশজুড়ে সমৃদ্ধিও বেড়েছে। ক্রিসমাসের উপহারগুলোও আরও দামি হয়ে উঠতে শুরু করে৷ এ সময় মানুষ প্রযুক্তিগত পণ্য এবং বিলাসবহুল সামগ্রীর দিকে ঝুঁকতে থাকে৷ ধর্মীয় উৎসবে এমন ভোগবাদের সমালোচনায় সোচ্চারও হন অনেকে৷
জার্মানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব
ক্রিসমাসে উপহার আদানপ্রদান ৭০ এর দশকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে৷ ফলে এই উৎসবটিও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উসবে পরিণত হয় দ্রুতই৷ ধর্মতত্ত্ববিদদের অভিযোগ, খ্রিস্টান ক্যালেন্ডারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হওয়ার কথা ইস্টার৷ কিন্তু বাণিজ্যিকীকরণের ফলে ক্রিসমাস পরিণত হয়েছে সবচেয়ে বড় উৎসবে৷
বদলে গেল উপহার
১৯৮০ এর দশকে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে বড়দিন উদযাপনেও৷ আগে যেমন কেবল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যই উপহার দেয়া হতো, এই সময়ে এসে অপ্রয়োজনীয় জিনিসও উপহারের তালিকায় স্থান পেতে শুরু করে৷
পুনরায় একত্রীকরণ এবং ক্রিসমাস
১৯৯০ এর দশকে আবার এক হয় দুই জার্মানি৷ পুনর্মিলনের পরে প্রথমবারের মতো জার্মানি জুড়ে প্রায় দুই কোটি মানুষ ক্রিসমাস উদযাপনে যোগ দেন। অনেক পরিবার জীবনে প্রথমবারের মতো একসঙ্গে ছুটি কাটানোর সুযোগ পায়৷ ফলে বড়দিনের উদযাপন এ সময়টিতে মানুষের জন্য বেশ আবেগের ব্যাপার ছিল৷
নতুন সহস্রাব্দে বড়দিন
সহস্রাব্দের শেষে, বিশ্বজুড়ে খ্রিস্টানরা যিশুর সহস্রতম জন্মদিন উদযাপন করেন। তবে জার্মানরা এই উৎসবের আসল কারণ থেকে দূরে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া, উপহার আদানপ্রদান এবং ক্রিসমাস পার্টির দিকে বেশই মনোযোগী হয়ে পড়েন৷। ধর্মীয় উৎসব ক্রিসমাস ধীরে ধীরে পরিণত হয় সামাজিক উৎসবে৷
আন্তর্জাতিকীকরণ
একসময় নিজেদের হাতে তৈরি জিনিসের কদর ছিল, মূল আকর্ষণ ছিল কারুপণ্য৷ কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছু কারখানায় উপাদন শুরু হয়৷ এমনকি বেশিরভাগ সাজসজ্জা ও উপহার সামগ্রীও এখন তৈরি হয় জার্মানির বাইরে, বিশেষ করে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে৷ বিশ্বায়নের হাত থেকে বাদ যায়নি ক্রিসমাসও৷
উৎসে ফেরার তাগিদ
কিছু পরিবার এখনও ঐতিহ্য ধরে রেখে বড়দিন পালন করে৷ সান্তা ক্লজ এবং তার উপহারের জন্য অপেক্ষা না করে বরং যিশু খ্রিস্টের আদর্শের প্রতি সম্মান জানাতে চান তারা৷ ধর্মভীরু অনেক পরিবার এদিন নিয়ম করে গির্জাতে যান৷