1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মেয়েদের জয়ে ফুল ফুটবে সবখানে

জনি হক ঢাকা
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতে একরকম জাতীয় বীরের মর্যাদাই পেয়েছেন বাংলাদেশের মেয়েরা৷ খেই হারিয়ে ফেলা ফুটবলের বাগানে সৌরভ ছড়িয়েছেন তারা৷

https://p.dw.com/p/4HGcf
নারী সাফের শিরোপা জয়ী বাংলাদেশ দল
নারী সাফের শিরোপা জয় করেছে বাংলাদেশছবি: Mir Farid

তাদের এই অর্জন খেলাধুলার অঙ্গনের বাইরেও নারীদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন৷ 

গত ১৯ সেপ্টেম্বর নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে স্বাগতিকদের ৩-১ গোলে পরাজিত করে শিরোপা জিতেছে সাবিনা খাতুনের দল৷ সাফজয়ী ফুটবলারদের ডানায় ভেসে ক্রীড়াঙ্গন হয়ে উঠেছে স্বপ্নপুরী৷ ছাদখোলা বাসে বীরকন্যাদের জয়যাত্রাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিবাদন জানিয়েছে সাধারণ মানুষ৷ তাদের অগ্রযাত্রা নিয়ে মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে ইতিবাচক মনোভাব৷

অধিনায়ক সাবিনা খাতুন থেকে শুরু করে কৃষ্ণা রাণী সরকার, সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার জুনিয়র, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শিউলি আজিম, সাজেদা, তহুরা আক্তার, মারজিয়া আক্তার, মাসুরা পারভীন, সিরাত জাহান স্বপ্না বেড়ে উঠেছেন গ্রামে৷ যেসব গ্রামে ফুটবল খেলা তো দূরের কথা, মেয়েদের বাজার করতে যাওয়াও ‘ভালো চোখে’ দেখে না সমাজ৷ সেরকম পরিবেশে স্থানীয় মাঠে খেলে, সাফল্য পেয়ে ঢাকায় এসেছেন তারা৷ এরপর ঢাকা থেকে দেশের বাইরে গিয়েও ছিনিয়ে এনেছেন ট্রফি৷

অভাব-অনটন, টিপ্পনী ও অবহেলার মধ্যে বেড়ে ওঠা পাহাড়ি মেয়ে রুপনা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা, আনাই মগিনী, আনুচিং মগিনী ও মনিকা চাকমা অদম্য মানসিকতা দেখিয়ে জীবনজয়ী হয়েছেন৷ সামাজিক প্রতিকূলতাকে জয় করে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে নিজেদের প্রমাণ করে যে দৃষ্টান্ত রাখলো তারা, ফুটবলে মেয়েদের এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে তা ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করেন বিভিন্ন অঙ্গনের প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা৷ অন্যান্য পেশায় আসতে চায় যেসব মেয়েরা, সাফ জয় তাদের অনুপ্রাণিত করবে বলে তাদের অভিমত৷

সব পেশায় নারীর অংশগ্রহণে এই বিজয় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে: রুমিন ফারহানা

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি'র দলীয় হুইপ রুমিন ফারহানা মনে করেন, রাজনীতিসহ সব পেশায় মেয়েদের অংশগ্রহণে এই বিজয় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘মেয়েরা স্বপ্ন দেখেছিল, সেই স্বপ্নপূরণে কোনো বাধাই তাদের আটকাতে পারেনি৷ সবারই পরিশ্রম ও চেষ্টা ছিল, এর বিপরীতে সমাজ ও চারপাশের ভ্রুকুটি ছিল৷ বিভিন্ন ধরনের সমালোচনাও তাদের পেরিয়ে আসতে হয়েছে৷ কোনো কিছুই তাদের পথকে রুদ্ধ করতে পারেনি৷ খুবই অমসৃণ ও বন্ধুর পথে তাদের হাঁটতে হয়েছে৷ কিন্তু কোনো বাধাই আসলে তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি৷ যদি স্বপ্নটা স্থির ও লক্ষ্য অটুট থাকে, তাহলে কোনো বাধাই বাধা নয়৷ পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাস যেকোনো বাধাকে জয় করতে পারে৷ প্রত্যন্ত এলাকায় অভাব ও দারিদ্র্যসহ সবকিছুকে জয় করে মেয়েরা আজ এই অবস্থানে পৌঁছেছে৷ আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজেদের স্বপ্ন ও লক্ষ্য অর্জনে কোনোরকম ছাড় দেয়নি তারা৷ সুতরাং রাজনীতি, সাংবাদিকতা, আইনসহ যে পেশাই হোক, নারীদের মধ্যে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্য যদি অটুট থাকে এবং আত্মবিশ্বাস ও পরিশ্রম থাকে, তাহলে কেউই সেই স্বপ্নের মাঝে বাধা হয়ে আসতে পারে না৷’

মেয়েরা বাধা পেরিয়ে জিতেছে বলেই তাদের অর্জন এতো অর্থবহ: জয়া চাকমা

বাংলাদেশের প্রথম নারী ফিফা রেফারি জয়া চাকমার দৃষ্টিতে, সাফ জয়ে ফুটবল নিয়ে মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাবে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আগে মানুষ ভাবতো– মেয়েরা খেললে কী আর হবে? খেলে যে কী হয় সেটা মেয়েরা দেখিয়ে দিয়েছে৷ তারা দেশের জন্য অনেক বড় সম্মান নিয়ে এসেছে, সবাই দেখেছে৷ আগে বাবা-মা খেলতে দিতে চাইতো না, এখন তারা আর বাধা দেবে না৷ ফলে খেলাধুলায় মেয়েরা আরও আগ্রহী হবে এবং নিজেরাই খেলোয়াড় হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে৷ আগে মেয়েরা নিজেরা কিংবা বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না৷ এখন সেই জায়গায় সুযোগ বাড়বে৷ কাজের জায়গা তৈরি হবে, রেফারি আসবে আরও৷ যে মেয়েরা ভাবতো রেফারিং করে কিংবা ফুটবলের সঙ্গে থেকে কী হবে, এখন তারা ভাববে– ফুটবল খেলে দিন শেষে মানুষ আমাকে চিনছে, সম্মান দিচ্ছে এবং আর্থিকভাবে নিশ্চিত জায়গা গড়ার সুযোগ থাকছে৷’

ফুটবল খেলায় মেয়েরা পেশাদারি পথ তৈরি করে ফেলেছে: নুসরাত ইমরোজ তিশা

মেয়েরা সাফল্যের এই পথ ধরে অনেক এগিয়ে যাবে বলে আশাবাদী অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘সমাজে প্রতিবন্ধকতা আছে, থাকবে৷ তবুও আমাদের মেয়েরা বিশাল বড় একটা জয় করে ফেললো৷ আমার মনে হয় না, আগামীতেও কোনো প্রতিবন্ধকতা কোনো মেয়েকে দাবিয়ে রাখতে পারবে৷ সত্যি বলতে পথ তৈরি করাটা খুব কঠিন৷ পথ একবার তৈরি হয়ে গেলে সেই পথ ধরে চলাটা খুব সহজ হয়ে যায়৷ বাংলাদেশে ফুটবল খেলার মতো পেশায় মেয়েরা ইতোমধ্যে পথ তৈরি করে ফেলেছে৷ অন্যান্য পেশায়ও মেয়েরা নতুন নতুন পথের বিস্তার করবে৷’

সাফ জয় মেয়েদের মধ্যে বিশ্বাস ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা চাইলে সব পারি: রাফিয়াত রশিদ মিথিলা

সাফ জয় বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন অভিনেত্রী ও উন্নয়নকর্মী রাফিয়াত রশিদ মিথিলা৷ তার কথায়, ‘এতো প্রতিবন্ধকতার পরেও আমাদের মেয়েরা বিজয়ী হয়েছে৷ তাই দেশের অন্য মেয়েদের এই বিশ্বাস ভেতরে ধারণ করা উচিত যে, আমরা চাইলেই পারি৷ সেটা যে পেশাই হোক আর যত কঠিন পেশাই হোক৷ মানুষ হিসেবে আমরা নারী-পুরুষ যেখান থেকেই আসি, যদি সত্যিই মনেপ্রাণে কোনো কিছু চাই তাহলে মেধা ও যোগ্যতা থাকলে তা অর্জন করা সম্ভব৷ মানুষ হিসেবে আমাদের সমপরিমাণ মেধা ও মস্তিষ্ক আছে৷ আমরা চাইলে সেটা ব্যবহার করে যে স্বপ্নটা দেখি সেটা পূরণ করতে পারি৷ সাফ জয় সকল মেয়ের মধ্যে এই বিশ্বাস ধারণ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা চাইলেই সব পারি৷’

মেয়েদের জয় ছেলেদেরও অনুপ্রেরণা জোগাবে: শারমিন সুলতানা সুমি

মেয়েদের এই অর্জন ছেলেদেরও অনুপ্রেরণা জোগাবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন সংগীতশিল্পী শারমিন সুলতানা সুমি৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘মেয়েদের এই বিজয় সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে গেছে৷ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ছেলেদের জন্যও এটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে৷ সবচেয়ে বড় কথা, এতো বড় বড় বাধা পেরিয়ে যারা এমন বিশাল সাফল্য অর্জন করে, তারা ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবার জন্য অনুপ্রেরণার৷ যেকোনো বয়সী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার৷ আমরা অনেকে ভাবি, একটু বয়স হয়ে গেলে কাজ করতে পারবে না, কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য পাবে না, তাদের জন্যও এই মেয়েরা অনুপ্রেরণার৷’

তবে মেয়েদের সামনে থেকে বাধা, প্রতিকূলতা ও বৈষম্য রাতারাতি মিলিয়ে যাবে না৷ সমাজে এসব ছিল, আগামীতেও থাকবে৷ এজন্য নারী-পুরুষের সমতার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য বিশিষ্টজনদের৷

মানবাধিকার নেত্রী এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা নারীর ক্ষমতায়নের যে কথাগুলো বলে থাকি সেদিক থেকে দেখলে সাফজয়ী সব ফুটবলারকে সামনে নিয়ে আসা উচিত ছিল৷ কিন্তু তিনজন ছাড়া বাকিদের দেখা যায়নি৷ বাফুফেতে খেলোয়াড়দের জন্য সংবর্ধনার কোনো মঞ্চ তৈরি করা হয়নি৷ এখানে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দেখলাম৷ তাছাড়া বেতনের বৈষম্য আছে৷ ফুটবলে মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা দ্বিগুণ বেতন পাচ্ছে৷ একটা সাফ জয় নারীর জন্য সব পথ খুলে দেবে না৷ একটা শিরোপায় সব অনুশাসন ভেঙে যাবে, আমরা অগ্রযাত্রার দিকে এগিয়ে যাবো, এসব ভাবা ভুল৷ রাষ্ট্র যদি পৃষ্ঠপোষকতা করে এবং নোটিশ দিয়ে জানিয়ে দেয় যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে র‌্যাংক অনুযায়ী নারী-পুরুষ সমান বেতন পাবে তাহলে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে৷’

এলিনা খানের কথায়, ‘ফুটবলার মেয়েরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে উঠে এসেছে৷ তারা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেছে৷ এক্ষেত্রে সমাজ খুব একটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি৷ বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্রশাসন, যেখানে মেয়েরা কাজ করছে সেখানকার লোকজন৷ সেসব জায়গায় যদি পরিবর্তন আনা যায় তাহলে আমরা অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে পারবো এবং অনুশাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পথ তৈরি হবে৷ তাই বেতন কিংবা মর্যাদা-সম্মান যাই বলেন, নারী-পুরুষের সমতা জরুরি৷’

জয়া চাকমার অভিমত, মেয়েরা বাধা পেরিয়ে জিতেছে বলেই তাদের এই অর্জন এতো অর্থবহ৷ তার মন্তব্য, ‘বাধা পুরোপুরি কেটে যাবে এমন হওয়া কঠিন৷ বাধা-প্রতিকূলতা সবসময় ছিল, এখনো আছে, সবসময় থাকবে৷ শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতসহ আমাদের আশেপাশে সব দেশেই আছে৷ বরং একহিসেবে আমরা অনেক ভালো অবস্থায় আছি৷ সাফ জয়ের ফলে সেটা কিছু ক্ষেত্রে কমবে৷ পুরোপুরি যে কমবে তা না৷ এমনও না যে, এটা কখনোই আর থাকবে না৷ এসব আগামীতেও থাকবে৷ বাধা না থাকলে মেয়েদের এই বিজয় অর্থবহ কেন হবে? তারা বাধা পেরিয়ে জিতেছে, মানুষ দেখেছে৷ কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকবেই৷ তবে মানুষ সচেতন হচ্ছে৷ সাফ জেতায় মেয়েদের কলিজা বড় হয়ে গেলো৷ যদিও মেয়েরা আগে থেকেই সাহসী৷ তারা ফুটবল খেলছে, এটা চাট্টিখানি কথা নয়৷ মেয়েরা আগে হয়তো ভাবতো আমি ঠিক নাকি ভুল, একটা সিদ্ধান্তহীনতায় হয়তো ভুগতো৷ একটা ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স হয়তো থাকতো৷ এমন জয়ের পর দেশব্যাপী মেয়েদের মধ্য থেকে সেটা পুরোপুরি কেটে যাবে, মেয়েরা এজন্য নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এবং তাতে অটল থাকতে পারবে৷ একইসঙ্গে তারা আত্মবিশ্বাসী হবে৷’

চিরকুট ব্যান্ডের সুমির ভাষায়, ‘পৃথিবীতে ছেলেমেয়ে সবারই বাধা থাকে৷ আমাদের সমাজে মেয়েদের বাধা বেশি৷ কিন্তু তারা বাধাকে পাত্তাই দেয় নাই, সাফ জয় এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ৷ আমি নিজেও মফস্বল থেকে উঠে আসা মেয়ে৷ আমারও এ পর্যন্ত আসতে বাধা পড়েছে৷ কিন্তু আমি কখনো বাধাকে বড় করে দেখি নাই৷ বাধাকে যারা বড় করে দেখবে তাদের জন্য জীবনের সকল সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবে৷ বাধা সকল উদ্যম খেয়ে ফেলে৷ সামাজিক কিংবা পারিবারিক বাধা একদিনে বদলানো যাবে না৷ সেদিকে না ভেবে নিজে যে কাজটা পারি তাতে মন দিতে হবে বেশি৷ নিজের কাজকে যদি ধৈর্য ধরে একটা পর্যায়ে নিতে পারি তাহলে সেটা আপনাআপনি সারা পৃথিবীর জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে যাবে৷ সাফজয়ী ফুটবলাররা এখন শুধু বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার৷ এটা সবচেয়ে ভালোলাগা ও উদ্যমের জায়গা৷ মেয়েরা যখন ছাদখোলা বাসে বিমানবন্দর থেকে বাফুফে যাচ্ছিল, তখন সড়কজুড়ে উদযাপনে ছেলেমেয়ে ভেদাভেদ ছিল না৷ বরং ছেলেরাই বেশি উদযাপন করেছে৷ আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এমনই৷ সবাই মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া ও ভালো থাকাই দেখতে চায়৷’

মিথিলার একই অভিমত, ‘সাফ জয় একটা মাইলফলক৷ তবে সমাজ এত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়৷ সেটা আস্তে ধীরেই হবে৷ কারণ এখনো কূপমন্ডুকতা আছে, অশিক্ষা আছে, মেয়েদের পেছনে টেনে ধরে রাখার অনেক লোক৷ আমার মনে হয়, পরিস্থিতি বদলাতে সময় লাগবে৷ তার মানে এই না যে, আমরা পারবো না৷ আমরা যে পারবো সেটা আমরা জেনেছি৷ আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে৷ আমরা ধাক্কা দিয়ে যতো সামনে এগিয়ে যাবো, সময়টা ততোই কম লাগবে৷’

সাফ ফুটবলে ছেলে হোক মেয়ে হোক, বাংলাদেশ বরাবরই ফাইনাল ও চ্যাম্পয়নশিপের জন্য খেলেছে বলে বিশ্বাস করেন জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক৷ তার দাবি, ২০১১ সাল পর্যন্ত এই মনোভাব ছিল৷ তখন সবার মধ্যে বিশ্বাস ছিল, সাফ ফুটবলে অংশগ্রহণ করা মানেই বাংলাদেশ ফাইনাল খেলবে! তার পর্যবেক্ষণে, ‘গত ১০-১১ বছরে সেই মানসিকতা থেকে দল সরে গিয়েছিল৷ অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো অনেক উন্নতি করেছে৷’

এমন অর্জন ধরে রাখার জন্য ফুটবলে পেশাদারি মনোভাব দরকার: আমিনুল হক

পেশাদারি মনোভাবের অভাবসহ ফুটবলের সামগ্রিক কাঠামোর দুর্বলতা এক্ষেত্রে দায়ী বলে মনে করেন আমিনুল হক৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘যেকোনো আন্তর্জাতিক অর্জন আমাদের অনেক অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে, অনেক বেশি স্বপ্ন দেখায়৷ এমন অর্জন ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশকিছু সুযোগ-সুবিধাসহ ফুটবলের সামগ্রিক কাঠামো থাকা দরকার৷ পেশাদারি মনোভাব কম থাকলে আমরা পিছিয়ে যাই৷ মেয়েরা ফুটবল খেলে বিজয়ী হয়েছে, এতে অনেক মেয়ে অনুপ্রাণিত হবে এবং পরিবার থেকে সমর্থন মিলবে৷ রক্ষণশীল সমাজে পরিবার থেকে মেয়েদের খেলাধুলায় খুব একটা উৎসাহ দেওয়া হয় না৷ তবুও পাহাড়ি কিংবা অন্যান্য অঞ্চলের মেয়েরা যে খেলছে তাতে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ এটা যদি আমরা ধরে রাখতে না পারি তাহলে কিন্তু আবার ব্যাকফুটে চলে যাবো৷ আমরা যখন ভালো খেলেছি তখন সবাই উচ্ছ্বসিত হয়েছে, কিন্তু পরে আবার খেই হারিয়ে ফেলেছি৷ এটা আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা৷ খেই হারানো যাবে না৷ খেলোয়াড় ও বাফুফে কর্মকর্তাদের মধ্যে পেশাদারি মনোভাব থাকলে আমরা ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো৷’

আমিনুল হকের চাওয়া, ‘আগামীতে মেয়েদের ফুটবল নিয়ে যেসব সুবিধা প্রয়োজন বাফুফে থেকে সেটা অবশ্যই দিতে হবে৷ সরকার থেকে যে সহযোগিতা করা দরকার সেটা অবশ্যই করা উচিত৷ মেয়েরা যেহেতু বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন পরিবার থেকে আসছে, তাদের যত বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে পরিবারের সমর্থনে তারা ততো বেশি ফুটবলের প্রতি আগ্রহী হবে৷ সেই পরিবেশটা যেন দৃশ্যমান হয়৷’

সুমি ব্যক্তিজীবনে বাধার মুখে পড়েছেন৷ তিনি সেসব জয় করেছেন৷ তার দৃষ্টিতে, ‘প্রত্যেকের জীবনের সংগ্রাম তার মতো করে৷ পেশা ভিন্ন ব্যাপার৷ মেয়েরা অনেকে গ্রাম ও পাহাড়ে বেড়ে উঠে অনেক কষ্ট করে ফুটবল খেলে আজ এখানে এসেছে৷ আমি মফস্বল থেকে এসে এই শহরে চা বিক্রি করেছি৷ গানে প্রতিষ্ঠা পেতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে৷ কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া যাবে না৷ আমার কাছে সবসময় মনে হয়, মেয়েদের উন্নতি সবাই খুবই পছন্দ করে, কিন্তু সেটা একটা গড় পর্যায় পর্যন্ত৷ মেয়েরা যখন শীর্ষে যায় তখন বাধা দ্বিগুণ হয়ে যায়৷ শীর্ষে যাওয়ার পর চেনা লোকও অচেনা হয়ে যায়৷ তাই এক্ষেত্রে একটু উদার হওয়ার আহ্বান জানাবো৷ মেয়েরা যে কাজটা করে অনেক মন দিয়ে করতে পারে৷ মেয়েদের মনোযোগ অনেক নিবিড় থাকে৷ তারা যখন এগিয়ে যায় তখন নতুন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়৷ মেয়েদের উন্নতি কোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে যেন থেমে না থাকে৷ তারা যেন উন্নতির চূড়ায় যেতে পারে৷ তাদের চূড়ান্ত জায়গায় যাওয়া শুধু তাদের নিজেদের কিংবা পরিবারের জন্যই নয়, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ তাই মেয়েদের যেন উৎসাহ দেওয়া হয়৷ কাঁধে হাত রেখে কিংবা মাথায় হাত দিয়ে তাদের বললেই হয়, এগিয়ে যাও৷ মেয়েরা এটুকুই চায়৷ বাকিটা পথ তারা ঠিকই উতরে যায়৷’

গ্রামেই ফুটবলার বেশি তৈরি হচ্ছে উল্লেখ করে মানবাধিকার নেত্রী এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘মানুষ শহরমুখী হয় কেন? মফস্বলে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধা মেলে না বলেই সবাই আশা নিয়ে শহরে আসতে চায়৷ কিন্তু এখানে তো মরীচিকা৷ প্রান্তির মেয়েরা কষ্টের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে৷ প্রত্যেকের কোনো না কোনো প্রতিভা থাকে; কারও খেলাধুলার, কারও আঁকাআঁকিতে৷ সেসব বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে৷ তাহলে গ্রাম থেকে আরও অনেক প্রতিভাবান মেয়ে উঠে আসবে৷ এবারের সাফ জয়ের পর মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে অভিনন্দন জানিয়েছে বলে রাষ্ট্র তাদের সম্মান দিয়েছে৷ রাষ্ট্র যদি গ্রাম থেকে প্রতিভাবান নারীদের তুলে নিয়ে আসে তাহলে সমতা তৈরি হবে৷ আমি মনে করি, নারীদের সেই মর্যাদা চলে আসবে৷ সেক্ষেত্রে সাফ জয় একটা দুয়ার খুলে দিলো৷ লোকজনের কাছে বার্তা পৌঁছে গেছে, ভালো খেললে প্রধানমন্ত্রী বাড়ি দিতে পারেন, কেউ হয়তো টাকা দেবেন৷ সেজন্য বিত্তবানদের হাত বাড়াতে হবে, রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে৷ প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে৷’