মৃত্যুপথযাত্রী কলকাতার পেশাদার নাটক
কলকাতার পেশাদার থিয়েটার মৃত্যুপথে। একসময় রমরমিয়ে চলা পেশাদার থিয়েটার হলগুলি প্রায় সব বন্ধ। পেশাদার নাটক আর হয় না। সেই থিয়েটার হলগুলি ঘুরে দেখল ডিডাব্লিউ।
পেশাদার থিয়েটারের রমরমা
গত শতকের ছয়, সাত, আট, নয়ের দশক জুড়ে বৃহস্পতি, শনি, রবি ও ছুটির দিন থিয়েটার-প্রেমী মানুষের ভিড়ে জমজমাট থাকত উত্তর কলকাতার হাতিবাগান, শ্যামবাজার চত্বর। কে অভিনয় করেননি তখন! উত্তমকুমার, সৌমিত্র, উৎপল দত্ত, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবিত্রী। তারও আগে গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শিশির ভাদুড়ীরা। সে সবই এখন ইতিহাস।
বিশ্বরূপা ভেঙে বহুতল বাড়ি
এই মঞ্চের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শিশির ভাদুড়ীর নাম। তিনি এখানে নাটক করতেন। পরে সেতু, এক পেয়ালা কফি, আগন্তুক, রাসবিহারী সরকারের পরিচালনায় শঙ্করের চৌরঙ্গী” বাঙালিকে একের পর এক ব্লকবাস্টার নাটক উপহার দেয়া এই রঙ্গমঞ্চ ভেঙে তৈরি হয়েছে বহুতল বাড়ি। নাটকের চিহ্ন বলতে শুধু শিশির ভাদুড়ীর এই মূর্তি।
রংমহল এখন শপিংমল
বিশ্বরূপা থেকে কয়েক কদম এগিয়ে বিধান সরণীতে উঠলে রংমহল থিয়েটার। যা এখন একটা শপিংমল। ধীরাজ ভট্টাচার্য, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মতো অভিনেতারা এককালে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন এই মঞ্চ। তার আর কোনো স্মৃতি রইলো না।
সত্তর বছরের আয়ু
'শতবর্ষ আগে', 'মায়ামৃগ', 'সাহেব বিবি গোলাম', এমনকী ৫০০ রজনী অতিক্রম করা 'উল্কা'-র মত নাটক এই রংমহল থিয়েটারেই একসময় মঞ্চস্থ হতো। ২০০১ সালে হলটি সম্পুর্ণ ভেঙে সেখানে শপিংমল নির্মাণ করা হয়। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কলকাতার প্রথম ঘূর্ণায়মান মঞ্চ।
স্টার থিয়েটার, নতুন রূপে
বিডন স্ট্রিটের পুরনো স্টার থিয়েটারে আগুন লাগে। তারপর পুরনো স্টার থিয়েটার ভেঙে তৈরি হয়েছে এই নতুন প্রেক্ষাগৃহ। গিরিশ ঘোষ, ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষের মত শিল্পীরা এককালে নিয়মিত পেশাদার নাটকে অভিনয় করতেন এই স্টার থিয়েটারে।
থিয়েটার নয়, সিনেমা
১৯৯১ সালের ১৬ অক্টোবর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়ে যায় ঐতিহ্যমন্ডিত স্টার থিয়েটার। তার বেশ কিছু বছর পর রাজ্য সরকার বাড়িটির পুনঃনির্মাণ করে। সামনের পুরনো স্থাপত্য অবিকল রেখে ভিতরের অংশে আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ তৈরি হয়। বর্তমানে এখানে আর পেশাদার থিয়েটার হয় না, সিনেমা দেখানো হয়।
রঙ্গনা এখন তালাবন্ধ
'জয়জয়ন্তী', 'কী বিভ্রাট', 'মোসায়েব', 'বাদশাহি চাল'-এর মতো সুপারহিট নাটক এখানে নিয়মিত মঞ্চস্থ হতো। নান্দীকার দীর্ঘদিন নাটক করেছে এখানে। পেশাদার থিয়েটারের অবস্থা খারাপ হওয়ার পর রঙ্গনা বন্ধ।
বিজন থিয়েটারের একই হাল
রঙ্গনার ঠিক বিপরীতেই বিজন থিয়েটার। ১৯৭৯ সালে তৈরি এই থিয়েটার হল সেই সময় অন্যান্য হলের সঙ্গে সদর্পে পাল্লা দিত। 'শ্রীমতী ভয়ঙ্করী,' 'জজ সাহেব', 'হারিয়ে পাওয়া'-র মত নাটক দিনের পর দিন হাউসফুল হতো” বোর্ড দেখতে পাওয়া যেত বিজন থিয়েটারের টিকিট কাউন্টারে।
এখন বিজন থিয়েটার
অভিনেতা ও নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের নামাঙ্কিত এই থিয়েটার হলের বর্তমান অবস্থা শিউরে ওঠার মতো। হাতিবাগানের পেশাদার থিয়েটারের রমরমার সময়েও বিজন থিয়েটারের নিজস্ব উদ্যোগে গ্রুপ থিয়েটারের দল দিয়ে বৃহস্পতি-শনি-রবির নিয়মিত অভিনয় প্রদর্শন করা হতো।
সারকারিনার সুদিন শেষ
১৯৭৬ সালে 'তুষার যুগ আসছে' নাটক দিয়ে শুরু। সার্কুলার আর এরিনা এই শব্দদুটি সন্ধি করেই এই থিয়েটারের নামকরণ। এমন থিয়েটার তখন সারাদেশে ছিল কিনা সন্দেহ। এখানেই দিনের পর দিন মঞ্চস্থ হয়েছে বিখ্যাত 'সম্রাট ও সুন্দরী' নাটকটি।
এরিনার আকর্ষণ
ঘুর্ণায়মান মঞ্চ হাতিবাগানের অন্য থিয়েটার হলে থাকলেও সারকারিনার বিশেষত্ব একটু অন্যরকম। মঞ্চটা ওপর নীচে ওঠানামা করতে পারত, তাই একটা বাড়তি আকর্ষণও ছিল। কতকটা স্টেডিয়ামের আকৃতি এই থিয়েটারের। বৃত্তাকার মঞ্চের চারপাশেই দর্শকাসন, সবই আজ অবহেলায় পড়ে রয়েছে।
কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ ও সৌমিত্র
কলকাতার পেশাদার থিয়েটার পাড়া বলতে বাঙালি হাতিবাগান আর বিডন স্ট্রিট অঞ্চলকেই বুঝত। পরবর্তীকালে থিয়েটার পাড়ার বাইরেও কয়েকটি হল তৈরি হয়। কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ তার মধ্যে প্রথম। পেশাদার থিয়েটারের বহু উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা হয়েছে এই মঞ্চে। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে বহু আলোচিত নাটক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘নাম জীবন’ এই মঞ্চে নিয়মিত মঞ্চস্থ হয়ে এসেছে। বর্তমানে এটা আসবাব তৈরির কারখানা।
বেহাল প্রতাপ মেমোরিয়াল হল
বাংলার পেশাদার থিয়েটার মঞ্চের ইতিহাসে প্রতাপ মঞ্চ এক উল্লেখযোগ্য নাম। ৭২ সালে এখানেই প্রযোজিত হয় শহর তোলপাড় করা নাটক ‘বারবধূ’। সেই নাটকের জন্য গান রচনা করেছিলেন গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, সুর দিয়েছিলেন নচিকেতা ঘোষ। কেতকী দত্ত অভিনীত সেই নাটক সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে একটানা এক হাজার ৮০০ রাত চলেছিল। পরবর্তীকালে সেই রেকর্ড ভাঙে ‘ওরা কারা’ নামের প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য একটি নাটক।
মিনার্ভা থিয়েটারের সুদিন
১৮৯৩ সালে শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। অহীন্দ্র চৌধুরী, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তের মত দিকপালেরা এককালে নিয়মিত মঞ্চ দাপিয়েছেন মিনার্ভায়। 'ছায়ানট', 'অঙ্গার', 'ফেরারি ফৌজ', 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'কল্লোল', প্রভৃতি নাটক সাফল্যের সঙ্গে নিয়মিত মঞ্চস্থ হতো এখানে।
আশায় বাঁচা
১৯২২ সালে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে একবার ছাই হয়ে গিয়েছিল মিনার্ভা। পরে আবার চালু হয়। এরপর সাতের দশকে এক অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে ভগ্নদশা প্রাপ্ত হয় এবং বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৮ সালে তৎকালীন রাজ্য সরকার এবং কিছু নাট্যব্যক্তিত্বের উদ্যোগে মিনার্ভা নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। আবার ঘুরে দাঁড়ায় এই থিয়েটার হল। আশা করাই যায়, মিনার্ভার মতো অন্য বন্ধ থিয়েটার হলও সরকারি হস্তক্ষেপে নতুন প্রাণ পাবে।