1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে

প্রভাষ আমিন
৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

কেউ কোনো পণ্য উৎপাদন করলে তা বিক্রির জন্য মানুষকে জানাতে চান৷ সেটা ঢেড়া পিটিয়ে হোক, মাইকিং করে হোক, মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে হোক, পোস্টার-লিফলেট ছাপিয়ে, পত্রিকায়-টিভিতে, অনলাইন-অফলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে হোক৷

https://p.dw.com/p/3ztfn
China 618 E-commerce 618 Festival | Apple
ছবি: Xing Yun/Costfoto/picture alliance

বিজ্ঞাপনের আদি কথা, ‘বিজ্ঞাপন না দিয়ে পণ্য বিক্রি করতে চাওয়া আর অন্ধকারে কোনো সুন্দরী মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা একই কথা৷' তাই পণ্য উৎপাদন আর বিজ্ঞাপন সমান্তরাল৷ তবে যুগ বদলানোর সাথে সাথে বদলে গেছে বিজ্ঞাপনের ধারণাও৷ এখন পণ্যের উৎপাদনের চেয়ে বিজ্ঞাপনের খরচ বেশি হয়ে যায় কখনো কখনো৷

বিজ্ঞাপনের খরচ কম হবে না বেশি হবে তা উৎপাদকের বিজনেস পলিসি৷ তিনি যদি বিজ্ঞাপনের পেছনে বাড়তি খরচ করেও পোষাতে পারেন, তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়৷ তবে অন্য সব ব্যবসার মত বিজ্ঞাপনেরও কিছু নীতি-নৈতিকতা থাকা দরকার৷

কিন্তু সমস্যা হলো, অন্য সব খাতের মতো বিজ্ঞাপনেও এখন নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই৷ আপনার কাছে টাকা থাকলে আপনি আপনার পণ্যের যে কোনো বিজ্ঞাপন অন্তত বাংলাদেশে প্রচার করতে পারবেন৷

একসময় পত্রিকার পাতা ভর্তি থাকতো অশ্লীল আর কুৎসিত হারবাল-এর বিজ্ঞাপনে৷ হরলিক্স খেলে আপনার শিশু ‘টলার, স্ট্রংগার, শার্পার' হবে, এই বিজ্ঞাপন আপনি বাংলাদেশে চালাতে পারবেন৷ কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকা বা আইনের শাসন আছে, এমন কোনো দেশে চালাতে পারবেন না৷

অপ্রমাণিত তথ্য, অবৈজ্ঞানিক ধারণার প্রচার বাংলাদেশে অহরহ হয়৷ বর্ণবাদী, নারী বিদ্বেষী, অপচিকিৎসার বিজ্ঞাপনে পত্রিকা-টিভি সয়লাব৷ এনার্জি ড্রিংক পান করে অসম্ভব সব কাজ মডেলরা করে ফেলেন অনায়াসে৷ এই বিজ্ঞাপন দেখে শিশুরা প্রভাবিত হয়, প্রতারিত হয়৷ বিজ্ঞাপন দিয়ে আপনি নিজের পণ্যের প্রচার করতে পারবেন৷ কিন্তু মানুষকে বিভ্রান্ত করতে, প্রতারিত করতে পারবেন না৷

বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের কোনো সেন্সর বোর্ড নেই৷ একসময় পত্রিকার চিঠিপত্রের পাতায় লেখা থাকতো, মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন৷ বিজ্ঞাপনের দায়ও কোনো সম্পাদক নেন না৷ কিন্তু পত্রিকার পাতায় ছাপা হওয়া নিউজের মত বিজ্ঞাপনও কেউ কেউ বিশ্বাস করেন৷ এর দায় কি সম্পাদক বা কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারবেন?

বেশ কয়েকবছর আগে বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় বেশ বড় করে একটি লোভনীয় বিজ্ঞাপন ছাপা হলো, বাংলাদেশে বসছে দুবাই আবাসন মেলা৷ মানে বাংলাদেশে বসেই আপনি দুবাইয়ের প্লট বা ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন৷

কিন্তু নির্ধারিত দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক মেলাটি বন্ধ করে দেয়৷ কারণ আপনি হয়তো প্লট বা ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন৷ কিন্তু টাকা পাঠাতে পারবেন না৷ এখন এই বিজ্ঞাপনের দায় কি এ পত্রিকাকে নিতে হবে না?

পত্রিকা বা টিভি বরাবরই বিজ্ঞাপননির্ভর৷ পত্রিকা বিক্রি করে তবু অল্পকিছু পয়সা আসে, টিভির আয়ের একমাত্র উৎস বিজ্ঞাপন৷ এই নির্ভরশীলতাটা আগেও ছিল৷ তবে এখনকার মত এত একচেটিয়া নয়৷ বিজ্ঞাপন ছাপা হতো পত্রিকার মাপমত৷ আর এখন পত্রিকায় নিউজ ছাপা হয় বিজ্ঞাপনের মাপ অনুযায়ী৷ লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর পড়তে হয় কোনো সুন্দরী মডেলের শরীরে ভাঁজে ভাঁজে৷

টিভিতে আগে খবরের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন দেখানো হতো৷ এখন বিজ্ঞাপনের ফাকেঁ ফাকেঁ নিউজ প্রচারিত হয়৷ তুমুল প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে গিয়ে আমরা নীতি-নৈতিকতার ধারণাটাই ভুলতে বসেছি৷

এখন সব বিজ্ঞাপন শুধু পণ্যের প্রচারের জন্য নয়, গণমাধ্যমকে হাতে রাখার অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা হয়৷ সাধারণত কোনো গণমাধ্যমই বিজ্ঞাপনদাতার কোনো নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ বা প্রচার করে না৷ বরং বিজ্ঞাপনদাতার তৎপরতার অসংবাদও সংবাদ মর্যাদা পায়৷ ধরুন আপনার টিভির শিরোনাম স্পন্সর করছে কোনো ব্যাংক৷ এখন আপনার টিভিতে কি সেই ব্যাংকের কোনো অনিয়মের সংবাদ শিরোনাম হবে? হওয়া উচিত, কিন্তু হয় না৷  

বিজ্ঞাপন বানাতে মডেল লাগে৷ আর মডেল হিসেবে বরাবরই নারীদের চাহিদা বেশি৷ পণ্যের চেয়ে নারী মডেলের শরীরের প্রদর্শনী হয় বেশি৷ এমনকি পুরুষদের পণ্যের মডেলও হন নারীরা৷

একসময় বাংলাদেশে ঐ বছরের আলোচিত সুন্দরী নারী লাক্স সাবানের মডেল হতেন৷ এখন বোধহয় বাংলাদেশে আর কোনো সুন্দরী নেই৷ তাই লাক্স সাবানের মডেলও পাশের দেশ থেকে আসে৷ আমার ঘোরতর সন্দেহ, লাক্স সাবানের কয়জন মডেল নিজে এই সাবানটি ব্যবহার করেন৷ শুধু লাক্স সাবান নয়, সব পণ্যের ক্ষেত্রেই আমার এই সংশয়টি রয়ে গেছে৷ সাধারণ মডেলদের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রের তারকারাও বিভিন্ন পণ্যের ব্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হন৷ এক্ষেত্রে তারকা খেলোয়াড়, সঙ্গীত তারকা বা সিনে তারকাদের বাজার ভালো৷ খেলোয়াড়রা খেলাধুলা করে যত টাকা পান, তারচেয়ে বেশি টাকা পান এন্ডোর্সমেন্টে৷

বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদকরা আসলে তারকাদের তারকামূল্যকে তাদের পণ্যের প্রচারে ব্যবহার করেন৷ তারকারা অনেকের আইডল হন৷ তাদের মুখের প্রতিটি কথা তাদের ভক্তরা অন্ধের মত বিশ্বাস করেন, লাইন ধরে সে পণ্য কেনেন৷

এই ব্র্যান্ড ভ্যালু কতটা গুরুত্বপুর্ণ সাম্প্রতিক একটি উদাহরণই যথেষ্ট৷ এবারের ইউরোর অন্যতম স্পন্সর ছিল কোকাকোলা৷ প্রতিটি সংবাদ সম্মেলনে তাই টেবিলের ওপর খেলোয়াড়দের সামনে কোকাকোলার বোতল থাকতো৷ একবার পর্তুগালের অধিনায়ক ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো সংবাদ সম্মেলনে এসেই কোকাকোলার বোতল সরিয়ে পানির বোতল তোলে ধরেন৷ এর ফলে পরদিন কোকাকোলার শেয়ার দরে ধ্বস নামে৷

তারকাদের ব্র্যান্ড ভ্যালুটা তাই খুবই মূল্যবান৷ তবে তারকাদের মনে রাখতে হবে, তারা আর দশটা সাধারণ মডেলের মতো নন৷ ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর মানে তাকে অবশ্যই সেই পণ্যের ভালো-মন্দের দায়িত্ব নিতে হবে৷

বাংলাদেশেও ইদানীং ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ধারণা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে৷ তবে বাংলাদেশের প্রথম অ্যাম্বাসেডর সম্ভবত মন্ত্রীরা৷ স্বৈরশাসক এরশাদ বিভিন্ন হুজুরের ভক্ত ছিলেন৷ আটরশিতে তার যাওয়া-আসা ছিল৷ যেতেন সাঈদাবাদী হুজুরের দরবার শরীফেও৷

Probhash Amin
প্রভাষ আমিন, সাংবাদিকছবি: DW

সাঈদাবাদী হুজুরের মালিকানাধীন কারখানা থেকে বাজারে আনা হলো ‘হিমেল ট্যালকাম পাউডার'৷ আর সেই পাউডারের মডেল হলেন এরশাদের মন্ত্রিসভার একঝাঁক মন্ত্রী৷ সবার নাম মনে নেই, তবে ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, কাজী জাফর আহমেদ৷ কাজী জাফর সম্ভবত তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন৷ সিনিয়র মন্ত্রীদের বাণী এবং ছবিসহ বিজ্ঞাপন ছাপা হতো পত্রিকায়৷ কাজী জাফর তার মন্তব্যে বলেছিলেন, হিমেল ট্যালকম পাউডার চুলকানীর জন্য খুব উপকারী৷ এ নিয়ে হুমায়ূন আজাদ লিখেছিলেন, ‘এ পাউডার বাজারে না এলে জাতি বুঝতেই পারতো না এরশাদের মন্ত্রীরা খোসপাচড়া আর চুলকানিতে আক্রান্ত৷'  গণঅভ্যুত্থানে উড়ে গিয়েছিল এরশাদের ক্ষমতার মসনদ৷ উড়ে গিয়েছিল হিমেল ট্যালকম পাউডারও৷

তবে এখন আর মন্ত্রীদের তেমন ব্র্যান্ড ভ্যালু নেই৷ ক্রিকেটাররা এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা ৷ আর তারকাদের তারকা সাকিব আল হাসান৷ তিনি অনেক পণ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর৷ সাকিব আল হাসান এখন আলেশা কার্ডের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর৷ মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা ছিলেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর৷

ই-ভ্যালির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হলেন অভিনেতা ও সঙ্গীতশিল্পী তাহসান৷ এমনকি ফেসবুক সেলিব্রেটি আরিফ আর হোসেনও মোটা বেতনে চাকরি করতেন ই-ভ্যালিতে৷

এখন যখন আস্তে আস্তে বিপাকে পড়ছে প্রতিষ্ঠানগুলো, তখন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডররা সটকে পরছেন৷ কিন্তু স্রেফ অস্বীকার করলেই তো আর দায় এড়ানো যাবে না৷ মাশরাফি বা তাহসানকে দেখে যারা ই-অরেঞ্জ বা ই-ভ্যালি থেকে পণ্য কিনতে আগাম অর্থ দিয়ে পণ্য পাচ্ছেন না বা প্রতারিত হচ্ছেন; তাদের দায়িত্ব কে নেবেন?

মাশরাফি দাবি করছেন, ই-অরেঞ্জের সাথে তার চুক্তি আগেই শেষ হয়ে গেছে৷ কিন্তু মাশরাফি ভক্তরা তো আর চুক্তির তারিখ দেখে পণ্য কিনতে যাননি, তারা মাশরাফিকে দেখে গিয়েছেন৷ মাশরাফী-সাকিব-তাহসানকে দেখেই গ্রাহকরা ই-অরেঞ্জ, ই-ভ্যালি বা আলেশা কার্ডে আস্থা রেখেছেন৷

এখন এই আস্থার মর্যাদা ও মূল্য অবশ্যই সেই তারকাকে দিতে হবে৷ কোম্পানির আর্থিক অবস্থা কেমন, মালিকরা কেমন এটা দেখেই তাদের সেই পণ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হওয়া উচিত ছিল৷

সাধারণ মানুষ তো এত কিছু বুঝবে না৷ তারা জানবে মাশরাফী যেহেতু আছে, তাই এই কোম্পানি ভুয়া হতে পারে না৷ মাশরাফীর সারাজীবনের ক্লিন ইমেজে কলঙ্কের দাগ লাগিয়ে দিয়েছে ই-অরেঞ্জ৷ আর গ্রাহকরা ই-অরেঞ্জের কাউকে না পেয়ে মাশরাফীর বাসা ঘেরাও করছে৷ চুক্তি ফুরানোর দাবি করলেও মাশরাফী অবশ্য এই লড়াইয়ে তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন৷ কিন্তু মাশরাফী নিশ্চয়ই প্রতারিত হওয়া সবার অর্থ ফেরত দিতে পারবেন না, আবার দায়ও এড়াতে পারবেন না৷

আপনি অবশ্যই অন্ধকারে সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে হাসবেন না, পণ্যের প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপন দেবেন, তারকাদের মোটা অঙ্কে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানাবেন৷ কিন্তু তাতে ন্যূনতম নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে৷ এই দায় তারকাদেরও নিতে হবে৷

শঙ্খ ঘোষের একটি জনপ্রিয় কবিতা দিয়ে লেখাটি শেষ করছি-  

‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি

… তোমার জন্যে গলির কোণে

ভাবি আমার মুখ দেখাবো

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে'৷

সেই কবিতায় এখন আরেকটি লাইন যুক্ত করা যায়৷ ব্যবসার, বিজ্ঞাপনের এই অনৈতিকতা, মডেল বা তারকা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরদের দায়িত্বহীনতায় আমাদের মুখ ঢেকে যায় লজ্জায়৷