1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার একটু সমালোচনা করি?

২২ এপ্রিল ২০২০

আপনাকে সরাসরি এই প্রশ্ন করার ক্ষমতা আমার নেই৷ তবে উত্তর ‘হ্যাঁ’ হতো ধরে নিয়েই লিখতে বসেছি৷

https://p.dw.com/p/3bFXV
ছবি: DW

এমনটা মনে করার কারণ, চারদিক থেকে সারাক্ষণ শুধু প্রশংসা আর তেলবাজি শুনতে আর দেখতে গিয়ে হয়ত আপনার একঘেয়েমি পেয়ে বসতে পারে৷ মাঝেমধ্যে বিএনপি যে সমালোচনার চেষ্টা করে সেটাও বোধ হয় আপনার কাছে একরকম বিনোদন মনে হয়! বিশিষ্ট নাগরিকদের (জানি সুশীল সমাজ কথাটা আপনার পছন্দ নয়) বিষয়েও এই কথা প্রযোজ্য৷ আর যারা আপনার সমালোচনা করতে পারতেন, সেই সাংবাদিকদের কলম আর ক্যামেরাও এখন সরকারি কাজে ব্যস্ত৷

এই অবস্থায় আমজনতাদের একজনের কাছ থেকে কিছু কথা শুনতে খারাপ লাগার কথা নয়৷

তাছাড়া এক যুগ ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার কারণে কিছু সমালোচনার জায়গা তো এমনিতেই তৈরি হয়েছে৷ সেগুলো ‘অ্যাড্রেস’ না করলে পরবর্তীতে সমস্যা হতে পারে৷

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী চলছে৷ আপনি তাঁর মেয়ে৷ আপনার বাবা সারা বাংলাদেশের মানুষের নেতা হতে পেরেছিলেন৷ আপনি এখনো সেই পর্যায়ে যেতে পারেননি৷ কারণ, দেশটা এখন বিভক্ত আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে৷ এখনকার সময়ে একজন সাধারণ নাগরিককে বাংলাদেশে কোনো সেবা পেতে হলে হয় তাকে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট কেউ হতে হবে, নয়ত তেমন কারো সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে হবে৷ বিএনপির আমলেও পরিস্থিতি এমন ছিল৷ দেশটা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেখানে ‘সাধারণ’-এর কোনো দাম নেই৷

অথচ দেশ হওয়া উচিত সব সাধারণ মানুষের৷ আর আপনার হওয়া উচিত সব নাগরিকের নেতা৷

বিতর্কিত কিংবা সঠিক যে-কোনো উপায়ে হোক, টানা ক্ষমতায় থেকে আপনার মধ্যে এখন চরম আত্মবিশ্বাস দেখা যাচ্ছে৷ এখান থেকে আপনার ক্যারিয়ারের পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ আছে৷ সেই সুযোগ গ্রহণ করুন৷

এক্ষেত্রে প্রথমেই আপনাকে যুক্তিনির্ভর সমালোচনা গ্রহণ করা শুরু করতে হবে৷ 

আপনাকে আমার এ ধরনের সমালোচনা শোনা ও গ্রহণ করতে আগ্রহী একজন ইতিবাচক মানুষ মনে হয়েছে৷ সেজন্যই সাহস করে লেখাটা লিখতে বসেছি৷ পাঠকদের অনেকে হয়ত সামাজিক মাধ্যমে আপনাকে নিয়ে কিছু লেখার কারণে অতীতে অনেকের কারাবাসের উদাহরণ দিতে চাইবেন৷ কিন্তু আমার মনে হয়, আপনাকে খুশি করার জন্য আপনার নেতা-কর্মীরা সেই উদ্যোগগুলো নিয়েছিলেন৷ আপনি জানলে হয়ত এমন না-ও হতে পারতো৷ আর এটাই (না জানা) আপনার বিরুদ্ধে আমার এক নম্বর সমালোচনা৷

সমালোচনা ১: সঠিক তথ্য পেতে ব্যর্থতা
তথ্য পাওয়ার জন্য আপনার অনেক সূত্র আছে৷ আমলারা আছেন, আছেন দলের নেতা-কর্মীরা, প্রেস উইংও আছে৷ কিন্তু সবাই সঠিক ও প্রয়োজনীয় তথ্য দিচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করার মতো কোনো উপায় বোধ হয় আপনার নেই৷ তাই মাঝেমধ্যে আপনাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়৷ যেমন, ১৬ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সামসুদ্দোহা সঞ্চয় যখন আপনার কাছে পর্যাপ্ত মাস্ক না থাকার কথা জানায়, তখন আপনি অবাক হয়েছিলেন৷ কারণ, ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে আপনি বলেছিলেন, ‘‘তাঁদের (স্বাস্থ্যকর্মীদের) সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে এবং যথেষ্ট পরিমাণ সরঞ্জাম মজুদ আছে৷ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীরও পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে৷ এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত হবেন না৷ স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে৷’’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ২৫ মার্চ আপনি জাতিকে জানিয়েছিলেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের যে শুধু পর্যাপ্ত সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে তা-ই নয়, যথেষ্ট পরিমাণে নাকি মজুদও আছে৷ কিন্তু আমরা বিভিন্ন সময়ে ডাক্তার ও নার্সদের কাছ থেকে নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকার অভিযোগ শুনেছি৷ এমনকি করোনা চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা ঢাকার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের কর্মীদের খাদ্যসংকটের অভিযোগও শুনেছি৷ সেই অভিযোগ প্রকাশ হওয়ার পর আপনার প্রশাসন সরকারি হাসপাতালে কর্মরত নার্সদের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে বারণ করেছে৷ এমনকি মাস্ক ও পিপিই সরবরাহ না পেয়ে স্বাস্থ্য সচিবের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার আবু তাহেরকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়েছে৷

আপনি কি জানেন, বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন বলছে, বিশ্বে চিকিৎসকদের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার হার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে অসত্য তথ্য দেয়ার উদাহরণ এখানেই শেষ নয়৷ ২৫ মার্চের ভাষণেই আপনি জানিয়েছিলেন, ঢাকায় ১০ হাজার ৫০টিসহ সারা দেশে ১৪ হাজার ৫৬৫টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে৷ অথচ তার মাত্র একদিন আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সারা দেশে চার হাজার ৫৩৯ এবং ঢাকা শহরে এক হাজার ৫০টি বেড প্রস্তুত থাকার কথা জানানো হয়েছিল৷

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাত্র একদিনে নিশ্চয় ঢাকায় নয় হাজার আর সারা দেশে দশ হাজার ২৬টি শয্যা প্রস্তুত হয়ে যায়নি! তাহলে আপনার ভাষণে এমন তথ্য কোথা থেকে এলো?

ধরে নিচ্ছি, আমলারা এসব তথ্য দিয়েছেন৷ তাঁরা কি ইচ্ছে করে এমন করেছেন, নাকি কোথাও ভুল হয়েছে?

উত্তর যদি প্রথমটা হয় তাহলে প্রশ্ন- এমন আচরণ করার সাহস তাঁরা কীভাবে পেলেন? নাকি কোনো কারণে তাঁরা ভাবছেন, আপনার সঙ্গে এমন করা তাঁদের অধিকার? কেন?

আর ভুল হয়ে থাকলে প্রশ্ন- এমন ভুল আর কত হয়েছে? কিছু ভুল হয়ত ধরা পড়ে, যা শোধরানো যায়৷ কিন্তু যেগুলো চোখের আড়ালে থেকে যায়?

এমন আমলাদের উপর আপনি এবার সারা দেশের ত্রাণ কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব দিয়েছেন৷ ফলাফল নিয়ে আমরা শঙ্কিত হতেই পারি৷

সমালোচনা ২: সংখ্যায় স্বস্তি
বিভিন্ন সময়ে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে আপনাকে বিভিন্ন পরিসংখ্যান উপস্থাপন করতে দেখা যায়৷ আপনার সরকারের নেয়া বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কতজনের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়েছে, তা জানান আপনি৷ এই তথ্যগুলোও নিশ্চয়ই আমলারা দিয়ে থাকেন৷ আমরা কি এসব তথ্য বিশ্বাস করবো? কারণ, আপনার ভাষণে দেশের প্রভুত উন্নয়নের কথা থাকে৷ যদি তাই হয়, তাহলে করোনার এই সময়ে ত্রাণের জন্য মানুষের এত হাহাকার দেখা যাচ্ছে কেন? তাহলে কি উন্নয়নটা টেকসই হচ্ছে না? নাকি আপনার প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছে আপনার দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা? সেজন্যই কি আপনি ত্রাণ তদারকিতে আর মন্ত্রী, এমপিদের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না? প্রকৃত দরিদ্ররা কি এসব সুযোগ-সুবিধার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, নিরপেক্ষ জায়গা থেকে এসব প্রশ্নের উত্তর আপনার জানার চেষ্টা করতে হবে৷ কীভাবে তা সম্ভব সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ থাকছে লেখার শেষ অংশে৷

সমালোচনা ৩: উদ্যোগ নিয়ে থেমে যাওয়া
গতবছর আপনি ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করেছিলেন৷ সেই সময় শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে যাওয়ারও অঙ্গীকার করেছিলেন৷ এরপর দুর্নীতি, চাঁদাবাজিতে জড়িত আপনার দলের কিছু কর্মী ধরাও পড়েছিল৷ এরপর হঠাৎই তা বন্ধ হয়ে যায়৷ তারও আগে উপজেলা নির্বাচনে দলের বিরুদ্ধে কাজ করা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের শাস্তি দেয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন৷ কিন্তু সেটাও হয়নি৷ এসব কারণে বর্তমানে আমরা চাল চোরদের দেখতে পাচ্ছি, যাদের বেশিরভাগই আপনার দলের কর্মী৷ এখনও আপনি তাদের ধরার ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখাচ্ছেন৷ কিন্তু তা-ও তা থামছে না৷ তাহলে কি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তারা ধরে নিয়েছেন শেষমেষ তাদের বেশিরভাগেরই কিছু হবে না?

এবার কিছু পরামর্শ৷

পরামর্শ ১: ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলুন
আমলা আর দলের নেতা-কর্মীরা অনেকদিন ধরে আপনাকে চেনার কারণে আপনি পছন্দ করবেন এমন তথ্যই শুধু আপনাকে দিচ্ছে, দেবে৷ ফলে দেশের আসল পরিস্থিতি হয়ত আপনার অজানাই থেকে যাচ্ছে৷

এজন্য আপনাকে তথ্য পাওয়ার কিছু বিকল্প উপায় বের করতে হবে৷ একটা হতে পারে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলা৷ তবে এমন অ্যাকাউন্ট যেন কেউ বুঝতে না পারে যে, ওটা আপনার অ্যাকাউন্ট৷ সেটি দিয়ে আপনি সরকারের সমালোচক (হতে পারে বিএনপি নেতা-কর্মীরাও) এবং মোটামুটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করেন, এমন ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অনুসরণ করতে পারেন৷ এরপর আপনার কাজ হবে দিনে অন্তত ১০-১৫ মিনিটের জন্য ফেসবুকে ঢোকা৷ তাহলে এমন কিছু তথ্য পাবেন, যা হয়ত আপনার প্রচলিত মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নয় (হতে পারে এই লেখাটিও!)৷

DW Bengali Mohammad Zahidul Haque
জাহিদুল হক, ডয়চে ভেলেছবি: DW/Matthias Müller

পরামর্শ ২: তালিকা পরিবর্তন করুন
এতদিন সরকার পরিচালনায় আপনি যে বিশিষ্টজনদের সহায়তা নিয়েছেন, সেই তালিকাতে পরিবর্তন আনুন৷ কারণ, তাঁদের অনেকের কাছ থেকেই আর নতুন কিছু পাওয়ার নেই৷ তাছাড়া তাঁরা পরামর্শের চেয়ে এখন আপনার প্রশংসাতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন৷

এর পরিবর্তে মোটামুটি নিরপেক্ষ/বিরোধী মতের নাগরিকদের তালিকায় যোগ করুন৷ শুরুতে টেলিফোনে তাঁদের সঙ্গে আলাপ হতে পারে৷ পরবর্তীতে চায়ের দাওয়াতও দিতে পারেন৷

পরামর্শ ৩: সাংবাদিকদের হাত শক্তিশালী করুন
আমলারা আপনাকে ভুল তথ্য দিচ্ছে, মন্ত্রী-এমপিরাও সঠিক তথ্য দিচ্ছে না, এই অবস্থায় আপনি আবার সাংবাদিকদের উপর ভরসা রাখা শুরু করতে পারেন, যদিও নানা কারণে অনেক সাংবাদিকই এখন সেলফ সেন্সরশিপে চলে গেছেন৷

এই পরিস্থিতি ঠিক করতে হবে মাননীয় প্রধামন্ত্রী৷ আপনার কাছ থেকে সাংবাদিকদের রক্ষার নিশ্চয়তা আসতে হবে৷ তাহলে দেখবেন আমলা, নেতা-কর্মীদের কারণে সঠিক তথ্য পাওয়ার যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা অনেকখানি কেটে যাবে৷

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এখন থেকে এসব বিষয় মাথায় রেখে কাজ করলে মানুষ আপনাকে আওয়ামী লীগের নেতা নয়, বরং সারা দেশের মানুষের নেতা হিসেবে আজীবন মনে রাখবে৷ আপনার বাবার মতো আপনার জন্মশতবার্ষিকীও এ দেশের মানুষ জাঁকজমকভাবে পালন করবে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান