মাংকিপক্সের প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা
২৪ জুলাই ২০২২বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস অ্যাধনম ঘেব্রেয়েসুস শনিবার মাংকিপক্সের প্রাদুর্ভাব বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছেন৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কমিটির সদস্যরা অবশ্য সবাই এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হননি৷ জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থার কোনো কর্তাব্যক্তি এই প্রথম এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিলেন৷
কী বলেছেন টেড্রোস?
টেড্রোস বলেন, ‘‘আমরা একটি প্রাদুর্ভাব দেখছি, যেটির সংক্রমণে নতুন মোড় নিয়ে দ্রুত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে৷ এটি সম্পর্কে আমরা খুব কম জানি এবং এটি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিধিমালার মানদণ্ড পূরণ করে৷ আমি জানি এটি একটি সহজ বা সরল প্রক্রিয়া ছিল না এবং কমিটির সদস্যদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমি আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করছি৷তবে এই মুহূর্তে এটি এমন একটি প্রাদুর্ভাব যা কেবল পুরুষের সঙ্গে পুরুষের যৌন সম্পর্কে কেন্দ্রীভূত৷ বিশেষ করে যারা একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত৷এর মানে হল যে এটি এমন একটি প্রাদুর্ভাব যা সঠিক কৌশল দিয়ে থামানো যেতে পারে৷''
প্রাদুর্ভাব যেভাবে ছড়িয়েছে
চলমান প্রাদুর্ভাব শুরু হয় মে মাসে৷ ব্রিটেনে ২০ মে ২০ জনের শরীরে মাংকিপক্স শনাক্ত হয়৷এদের বেশিরভাগই ছিলেন সমকামী পুরুষ৷
এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ৭৫টি দেশে ১৬ হাজারেরও বেশি মানুষের দেহে এই রোগের জীবাণু পাওয়া গিয়েছে৷ টেড্রোস জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির তথ্য অনুযায়ী এক দিনেই দেশটিতে এর প্রাদুর্ভাব এক হাজারেরও বেশি মানুষের শরীরে ছড়িয়েছে৷ ১৯ জুলাই ১৪ হাজার ৫১১ জন থেকে ২০ জুলাই এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৩৭৮ জনে৷ তবে এখনই প্রাদুর্ভাবটি মূলত ইউরোপেই কেন্দ্রীভূত রয়েছে৷
১৪ জুলাইয়ের পর থেকে থাইল্যান্ড, সার্বিয়া, জর্জিয়া, ভারত, সৌদি আরবসহ নানা দেশ তাদের প্রথম মাংকিপক্স রোগী শনাক্তের তথ্য জানায়৷ তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে কি না, এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে মহামারি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে৷২৩ জুলাই একটি সভায় তাদের অনেকেই মাংকিপক্সকে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণায় বিষয়ে একমত হননি৷ পরবর্তীতে আবার আলোচনার জন্য বৈঠক আহ্বান করা হয়৷
লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন এর আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক জিমি হুইটোয়ার্থ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘কমিটির জন্য এটা একটা জটিল সিদ্ধান্ত ছিল৷ একদিকে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে৷ যেভাবে এটি এতগুলো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পেলে নিয়ন্ত্রণে আনতে সুবিধা হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তবে অন্যদিকে, এটা এমন এক সংক্রমণ যা নিয়ন্ত্রণের উপায় আমাদের কাছে রয়েছে৷ বেশিরভাগ সংক্রমণই মৃদু এবং মৃত্যুর হারও খুব কম৷''
আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা কী?
আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বোচ্চ সতর্কতা৷ ২০০৫ সালের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিধির ওপর ভিত্তি করে আন্তঃসীমান্ত জনস্বাস্থ্য উদ্বেগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের অধিকার এবং দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয় এর মাধ্যমে৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কমিটিতে ১৬ জন সদস্য রয়েছেন৷ এর চেয়ারম্যান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর জ্যঁ-মারি ওকুও-বেলে৷এর আগে সংস্থার টিকা ও টিকাদান কর্মসূচির প্রধান ছিলেন তিনি৷ কমিটির বাকি সদস্যরাও বিভিন্ন দেশের মহামারি এবং নানা রোগের বিশেষজ্ঞ৷
আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো একটি প্রাদুর্ভাব ব্যাপক আকারে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকলে আগে থেকেই সে বিষয়ে সতর্ক করা৷ এর ফলে নানা দেশের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সহজ হয় এবং দ্রুত নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখা যায়৷
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এর ফলে বাণিজ্য ও ভ্রমণ বন্ধ হয়ে গেলে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ে৷ এমন আশঙ্কায় অনেক দেশই নিজেদের সীমান্তের মধ্যে প্রাদুর্ভাবের সঠিক তথ্য জানাতে গড়িমসিও করে৷
এখনো পর্যন্ত ছয় বার
আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা এখনো পর্যন্ত ছয় বার ঘোষণা করা হয়েছে।
- ২০২০ সালের জানুয়ারিতে চীনের বাইরে প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্তহওয়ার পর এটিকে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়৷ পরবর্তীতে দ্রুতই এটি বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হয়৷
- ২০১৯ সালের জুলাইয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ইবোলা নিয়ে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়৷
- এবার এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল পূর্ব ডিআরসিতে৷
- ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি হয়। ব্রাজিলসহ প্রায় পুরো ল্যাটিন অ্যামেরিকা মহাদেশেই এর সংক্রমণ ঘটেছিল৷
- ২০১৪ সালের আগস্টে ইবোলার জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়৷
- পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ছাড়াও ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রেও ছড়িয়েছিল এই ভাইরাস৷
- ২০১৪ সালের মে মাসে পোলিওর সংক্রমণ নিয়ে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়৷ আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং নাইজেরিয়ায় টিকা না পৌঁছানো কিছু অঞ্চলে 'ওয়াইল্ড পোলিও' ছড়িয়ে পড়ে৷করোনার পাশাপাশি এই রোগের আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা এখনও জারি রয়েছে৷
- ২০০৯ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল এইচ ওয়ান এন ওয়ান বা সোয়াইন ফ্লু এর জন্য৷ মেক্সিকো থেকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এ রোগ৷
এরপর কী?
- মাংকিপক্সের টিকা আগেই আবিষ্কার হয়েছে এবং তা সংক্রমণ ঠেকাতে বেশ কার্যকরও৷ কিন্তু দ্রুত এই রোগ ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বজুড়ে বিপুল সংখ্যায় টিকা উৎপাদন, সরবরাহ ও টিকাদান নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়ে পারে৷
- টেড্রোস জানিয়েছেন, মাংকিপক্সের সংক্রমণ ঠেকাতে নিজেদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য কাজে লাগাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ কেউ কেউ অবশ্য এখনো পর্যন্ত পাওয়া সংখ্যা ও তথ্যের ভিত্তিতে এই রোগের মহামারিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন৷
- তবে এমন সম্ভাবনা বিষয়ে দ্বিমতও রয়েছে৷ জনস্বাস্থ্যের অধ্যাপক হুইটওয়ার্থ বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সাধারণ মানুষের মধ্যে এটা বেশি ছড়ানোর আশঙ্কা খুব কম৷ ফলে আমি মনে করি না, এটা মহামারিতে পরিণত হবে৷''
এডিকে/আরকেসি (রয়টার্স, এএফপি)