1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মমতার আশ্বাস প্রচুর, তাতে মানুষের আস্থা থাকবে তো?

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি
২২ জুলাই ২০২২

তৃণমূল কংগ্রেসে একটা চালু কথা আছে, ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে দিশানির্দেশ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার কী দিশানির্দেশ দিলেন তিনি?

https://p.dw.com/p/4EVMG
২১ জুলাইয়ের সভায় ভাষণ দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
২১ জুলাইয়ের সভায় ভাষণ দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: Subrata Goswami/DW

১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন ১৩ জন প্রতিবাদকারী। প্রতি বছর তাদের স্মরণে ২১ জুলাইয়ের জনসভা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শহিদ স্মরণের অনুষ্ঠান। করোনার সময় শহিদ স্মরণের অনুষ্ঠান হয়েছিল অনলাইনে। এবার অবশ্য ধর্মতলায় ২১ জুলাইয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে। তৃণমূলের লাখো কর্মী সমর্থক তাতে যোগ দিয়েছেন। তারা পতাকা দুলিয়েছেন। স্লোগানে মুখরিত হয়েছে সভাপ্রাঙ্গন। ধর্মতলায় এই অনুষ্ঠানে ছিল উৎসবের আমেজ। দীর্ঘদিন পর এরকম বড় মাপের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে ঠাসাঠাসি ভিড়ে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূল কর্মী, সমর্থকরা।

হাইকোর্টের নির্দেশ

যখন এই অনুষ্ঠান হলো, যখন দেশে প্রতিদিন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টাতেও ৪৫ জন করোনার কারণে মারা গেছেন। আর এই করোনা আক্রান্তের সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের স্থান দেশের মধ্যে দুই নম্বরে। কলকাতা হাইকোর্টের নর্দেশ ছিল, সমাবেশে কঠোরভাবে করোনা বিধি মানতে হবে। 

তারপরেও যেভাবে ঠাসা ভিড়ে জনসভা হয়েছে, তাতে এরপর পশ্চিমবঙ্গে করোনা লাফিয়ে বাড়লেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ভারতে অবশ্য করোনাকালেও দেখা গেছে উৎসব অনুষ্ঠানে ভিড় উপচে পড়ছে। তবলিগ জামাতের অনুষ্ঠান থেকে কুম্ভ মেলা পর্যন্ত তার অনেক উদাহরণ আছে। সেই তালিকায় এবার ২১ জুলাইয়ের সভাও ঢুকে যাবে। প্রশ্ন হলো, এখানে হাইকোর্টের নির্দেশের পরেও করোনাবিধি মানা হলো না কেন?

২১ জুলাই ভিড়ের ছবি।
২১ জুলাই ভিড়ের ছবি। ছবি: Subrata Goswami/DW

কিন্তু এর পাশাপাশি যে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটা সামনে আসছে, তা মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ নিয়ে। ঠিক কি দিশানির্দেশ দিলেন তিনি? শুধুই কি সেই দায় এড়িয়ে যাওয়ার পুরনো প্রয়াস, নাকি তার থেকেও বেশি কিছু? একবার চোখ ফেরানো যাক মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণের দিকে।

আপনি একা সাধুপুরুষ?

সিপিএম সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ''কি বিকাশবাবু, আপনি একা সাধুপুরুষ? ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না? আপনার আমলে কাদের বার্থ সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছিল? বার করব সেই ফাইলগুলো?'' মমতা বলেছেন, ''আমি শুনেছি, সিপিএমের আমলে তাদের মুখপত্রে যে সব মানুষ কাজ করতেন, তাদের স্ত্রীদের অন্য কোথাও চাকরির ব্যবস্থা করে দিত সিপিএম।''

২১ জুলাইয়ের মতো দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশে বিকাশরঞ্জনের বিরুদ্ধে কেন বিষোদ্গার করলেন মুখ্যমন্ত্রী? সম্ভবত কারণটা হলো,  রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে একাধিক মামলা লড়ছেন বিকাশরঞ্জন। যে মামলা নিয়ে রাজ্য সরকার যথেষ্ট বিপাকে পড়েছে। কিন্তু ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী যা করেছেন, তা হলো হুমকি দেয়া। ফাইল প্রকাশ করার হুমকি। ঘটনা হলো, সিপিএম আমলে কোনোরকম দুর্নীতি হয়ে থাকলে তা সামনে আনা তো মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য। তা না করে, তিনি এই ধরনের হুমকি দিচ্ছেন কেন? তাছাড়া সিপিএমের আমলে যদি ক্যাডার বা নেতাদের স্ত্রীরা চাকরি পান, তাহলে তো প্রথমে দেখতে হবে, তারা বেআইনিভাবে চাকরি পেয়েছেন কি না। বেআইনিভাবে না পেলে কাউকে চাকরি দেয়াটা তো ভালো কাজ। সেখানে আপত্তি কোথায় থাকতে পারে? আর বেআইনিভাবে চাকরি দেয়া হলে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না?

আপত্তি তখনই ওঠে, যখন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা, আত্মীয়, অনুগামীদের সব নিয়ম ভেঙে চাকরি দেয়া হয়। যে অভিযোগটা এসএসসি কেলেঙ্কারিতে উঠেছে। হাইকোর্টের বিচারপতি মন্তব্য করেছেন। তৃণমূল মন্ত্রীর মেয়েকে যে সব নিয়ম ভেঙে চাকরি দেয়া হয়েছিল, সেটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে। আদালতের হস্তক্ষেপে তার চাকরি গেছে। যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নিই যে, বামেদের আমলে সিপিএমের মুখপত্রের সঙ্গে জড়িত কর্মীর স্ত্রীদের বেআইনিভাবে চাকরি দেয়া হয়েছিল, তাহলেও কি বর্তমান সরকারের আমলে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি ঢাকা যায়? আমরা তো ছোটবেলা থেকে এটাই শিখে আসছি, একটা ভুল দিয়ে অন্য ভুলকে ঢাকা যায় না। কোনো কাজ অন্যায় হলে রাম করলেও অন্যায়, শ্যাম করলেও অন্যায়। সেই অন্যায় বন্ধ না করে শুধুই অভিযোগ করলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে বলে তো মনে হয় না।

শিল্প কোথায়?

২১ জুলাইয়ের সভাতে মমতা শিল্প ও উন্নয়নপ্রকল্প নিয়ে অনেক ভালোভালো কতা শুনিয়েছেন। কিছুদিন আগে বিশ্ব বাংলা বাণিজ্য সম্মেলন হয়েছে। সারা দেশের ও বিদেশের শিল্পপতিরা এসেছেন। প্রচুর সমঝোতাপত্র সই হয়েছে। এতদিন ধরে শিল্পসম্মেলনে যত সমঝোতাপত্র সই হয়েছে, তা রূপায়িত হলে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পে ভেসে যেত। কিন্তু গলির মোড়ের চপ ও ঝালমুড়ি শিল্প ছাড়া, আর কোনো শিল্পেরই তো রমরমা নেই। 

চাকরি রেডি

মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ১৭ হাজার শিক্ষকের চাকরি রেডি। আদালত বললেই তিনি চাকরি দিয়ে দেবেন। তিনি চাকরি দেন, বিজেপি চাকরি নিয়ে নেয়। 

ঘটনা হলো, গত কয়েক বছর ধরে চাকরিপ্রার্থীরা পশ্চিমবঙ্গে কম আন্দোলন করছেন না। শিক্ষকদের আন্দোলন তো আছেই, তার পাশাপাশি নার্স, পুলিশের কনস্টেবল সহ অনেকেই বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। পূর্ণ সময়ের চাকরি বন্ধ রেখে সিভিক ভলেন্টিয়ার্স, পার্ট টাইম শিক্ষক ও অধ্য়াপকের মতো কম খরচের নিয়োগে বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে রাজ্য। আর নিয়োগ নিয়ে একের পর এক দুর্নীতির  অভিযোগ উঠছে। ধরে নিলাম, আদালতে মামলা চলছে বলে ১৭ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি দেয়া যাচ্ছে না, কিন্তু বাকিদের চাকরি দিতে তো কোনো অসুবিধা নেই। সেখানে কেন চাকরি দেয়া হচ্ছে না? সরকারি নিয়োগে কড়াকড়ির কারণ, আর্থিক সংকট। ভোটে জেতার জন্য দুই হাতে বিনা পরিশ্রমে মানুষকে সামান্য টাকা দিচ্ছেন মমতা। ফলে লক্ষ্মীর ভান্ডারে নারীরা পাঁচশ টাকা পাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু সরকারের ভান্ডার খালি হয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রের বিমা প্রকল্প আছে, কিন্তু মমতা জেদ করে রাজ্যের বিমা  প্রকল্প চালু করেছেন। কৃষকদের কেন্দ্রের টাকা না দিতে দিয়ে, নিজে কিছু সুবিধা দিচ্ছেন।  এরফলে নতুন করে সরকারি নিয়োগ প্রায় বন্ধ রাখতে হয়েছে। 

মুড়িতে জিএসটি

সম্প্রতি জিএসটি কাউন্সিল প্যাকেটের মুড়ি সহ একাধিক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের উপর জিএসটি বসিয়েছে। সেই মুড়িতে জিএসটির প্রসঙ্গ তুলে মমতা প্রশ্ন করেছেন, ''মানুষ খাবে কি?'' তিনি স্লোগান দিয়েছেন, ''আমাদের মুড়ি ফিরিয়ে দাও, নইলে বিজেপি বিদায় নাও।'' রাজনৈতিক স্লোগান তিনি দিতেই পারেন, ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে প্রয়ুর স্লোগান তিনি দিয়েছেনও। কিন্তু চণ্ডীগড়ে জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে যেখানে একগুচ্ছ জিনিসের উপর জিএসটি বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেথানে কি পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি ছিলেন না? বৈঠক শেষ হওয়ার পর অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন স্পষ্ট দাবি করেছিলেন, সব রাজ্যের সম্মতিতে জিএসটি বাড়ানো হয়েছে। সেই সব রাজ্যের মধ্যে তো পশ্চিমবঙ্গও থাকবে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর দাবিমতো, সকলেরই জিএসটি বাড়ানোর প্রস্তাবে সম্মত ছিল। তাহলে?

'টাকা তুললে পুলিশকে জানান'

তৃণমূলের নেতা, কর্মী, সমর্থকদের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তৃণমূল বৈভব দেখানোর জায়গা নয়। দু-একটা অভিযোগ তিনি পেয়েছেন। তার হুঁশিয়ারি, তৃণমূলের নাম করে কেউ টাকা তুলবেন না। টাকা তুলতে দেখলে সোজা থানায় জানাবেন। তাকে ধরে থানায় নিয়ে যাবেন। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশমন্ত্রীও। তিনি তোলাবাজির কয়েকটা অভিযোগ পেয়েছেন। তারপর কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? একটু কান পাতলেই তো মুখ্যমন্ত্রী শুনতে পেতেন, সিন্ডিকেটরাজ নিয়ে, তোলাবাজি নিয়ে, গুণ্ডামি নিয়ে মানুষের মতটা কি ? সবকিছুই যে বিরোধীদের প্রচার বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না, সেটা তো তিনি স্বীকারই করে নিলেন, টাকা তোলার কথা বলে। এখন টাকা তুলতে দেখলে, তোলাবাজি করতে দেখলে কে থানায় অভিযোগ করবে? মানুষের প্রাণের ভয় নেই না কি? উপর থেকে নির্দেশ না এলে থানা কি একজন তৃণমূল কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে? এককথায় জবাবটা হলো না, পারে না। আর তৃণমূল নেতাদের বৈভবের ছবিটাও যে মাঝেমধ্য়ে সামনে এসে যাচ্ছে। রামপুরহাটকাণ্ডের পর এক তৃণমূল নেতার প্রাসাদোপম বাড়ির ছবি সামনে এসেছে। এসব থেকে কী বোঝা যাচ্ছে? এভাবে সব দায় মানুষের উপর চাপিয়ে না দিয়ে, মুখ্যমন্ত্রীরও তো উচিত কিছু ব্যবস্থা নেয়া।

'এক ছাতার তলায়'

মমতা বলেছেন, ২০২৪-এর নির্বাচনে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তারপর অন্যান্য দল এক ছাতার তলায় আসবে। তার মানে, ভোটের আগে বিরোধী জোট হবে না? অর্থাৎ, বিরোধীদের একজোট করার জন্য মমতা যে চেষ্টা করছিলেন, দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ঠিক করার জন্য বৈঠক পর্যন্ত ডাকলেন, সে সবই ব্যর্থ হলো। না কি, উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূল যে ভোটদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেসব ঢাকার জন্য এই কথা। কারণ, উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরেোধী দলের প্রার্থী মার্গারেট আলভাকে ভোট না দেয়ার অর্থ হলো, বিরোধীদের সঙ্গে না থাকা। এমনকি বিরোধীরা এই সমালোচনাও শুরু করেছেন, মমতা ধনখড়ের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন না বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তাহলে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে কি মমতা শুধুই দায় এড়ানোর চেষ্টা করে গেলেন?