1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘‘ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়াতে সব চেষ্টাই করেছি”

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৬ জুলাই ২০২১

ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেছেন, ‘‘আমরা চেষ্টা করেছি। আমাদের সক্ষমতাও অনেক বেড়েছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে ভয় কমে গেছে।”

https://p.dw.com/p/3waxA
ছবি: Md Rafayat Haque Khan/Zuma/picture alliance

সংক্রমণের প্রায় দেড় বছর পর বাংলাদেশে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে করোনা। এই দেড় বছরে স্বাস্থ্য বিভাগের যে কাজগুলো করা প্রয়োজন ছিল, সেগুলো কী করা গেছে? কেন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি?

ডয়চে ভেলে: করোনার বর্তমান পরিস্থিতি কী আপনাদের নিয়ন্ত্রণে আছে?

অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম: এখন পর্যন্ত আমরা আয়ত্ত্বে রেখেছি। পরের খবর কী হবে সেটা তো বলতে পারছি না।

এই পরিস্থিতি আমরা চাইলেই এড়াতে পারতাম কি-না?

আমরা তো এই পরিস্থিতিটা এড়ানোর জন্য চেষ্টা করেছি। আপনারা তো জানেন আমরা কী অবস্থার মধ্যে দিন পার করেছি। আমরা তো কোন কিছুই মানিনি। যেসব বিধিনিষেধ করা হয়েছে তার কোনটাই মানা হয়নি। মানা হয়নি বললে ঠিক হবে না, সঠিকভাবে আমরা মানতে পারিনি।

এখনও মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানতে চান না। আমরা এতদিনেও কেন মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে পারিনি। গলদটা কোথায়?

গলদের চেয়ে বলব, আমাদের অসচেতনতা। প্রথম যখন করোনা এল তখন মানুষ এটাকে যেভাবে ভয় পেত, এখন সেভাবে আর ভয় পায় না। কেয়ার করে না। বিশেষ করে তরুণেরা ভয় পায় না। আমাদের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ তো ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। তারা বাইরে ঘোরে। আক্রান্ত হয়, কিন্তু তাদের তো খুব একটা সমস্যা হয় না। তারা ঘরে ফিরে সিনিয়র সিটিজেনদের আক্রান্ত করে। এখন যারা মারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই ৫০ বছরের ওপরে। তারা কিন্তু ঘরের বাইরে বের হন খুব কম। তাহলে তাদের কাছে জীবাণু পৌঁছে দিচ্ছে কারা? তাদেরই ঘরের যারা কম বয়স্ক তারাই এই জীবাণু ছড়ানোর কাজটি করছেন। এছাড়া তো এর কোন ব্যাখা খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

করোনার শুরুতে আপনারা যে কাজগুলো করতে চেয়েছিলেন সেগুলো কী করতে পেরেছেন?

আমি বলব, অনেকখানি পেরেছি। করোনার শুরুতে তো আমাদের টেস্টিং সুযোগই ছিল না। এখন দেখেন টেস্টের কতগুলো দিক বেরিয়েছে। প্রথমে তো আমরা একটা দিয়ে শুরু করেছি, এখন ২০০ এর বেশি ল্যাবরেটরি কাজ করছে। নির্ণয়ের একটা বড় জায়গা আমরা তৈরি করেছি। হাসপাতালে বেড তো ছিলই না। এখন করোনার জন্য  ১৭ থেকে ১৮ হাজার নির্ধারিত বেড আছে। একদিন আগেই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালকে করোনার জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সব ফোকাস চলে গেছে করোনার দিকে। ফলে করোনার বেড বেড়েছে। কিন্তু নন কোভিড রোগীদের ভোগান্তি অনেক বেড়ে গেছে। এটা কিন্তু আমরা খেয়াল করছি না। রোগী উৎপাদনের জায়গায় আমরা অবহেলা করছি। কিন্তু খালি বলছি, করোনার বেড বাড়ছে না কেন? আইসিইউ বাড়ছে না কেন? আগে রোগী তৈরি করা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে অন্য রোগের রোগীরা কোথায় যাবেন? আমাদের ডাক্তার তো বাড়েনি। একই ডাক্তার করোনা রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছে, আবার নন কোভিড রোগীকেও চিকিৎসা দিচ্ছে। আমাদের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সক্ষমতারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে।

এই দেড় বছরেও আমরা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে করোনা চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করতে পারিনি। এই সময়টা কি পর্যাপ্ত ছিল না? 

পারিনি এই কথা ঠিক না। এখন প্রতিটি উপজেলায় অক্সিজেনের ব্যবস্থা আছে। এখন যদি বলেন, প্রতিটি উপজেলায় আইসিইউ নেই কেন? সেটা তো সম্ভব না। পৃথিবীর কোথাও নেই। প্রাইমারি লেভেলে কোথাও আইসিইউ থাকে না। এমনকি সেকেন্ডারি লেভেলেও থাকে না। তৃতীয় বা চতুর্থ লেভেলে আইসিইউ থাকে। উপজেলা পর্যায়ে যারা কাজ করছেন তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত বেডও আছে। এখন তো চিকিৎসা শুধু অক্সিজেন। যারা করোনা আক্রান্ত হন তাদের মধ্যে পাঁচ শতাংশের অবস্থা খারাপ হয়। তাদের এই সাপোর্ট লাগে। অনেকে আবার বলেন, হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা নেই কেন? এটা তো সবার জন্য না। এতে অক্সিজেনের অপচয় সবচেয়ে বেশি। এটা যেহেতু অনেক ফোর্সে দেওয়া হয়, তাতে এখানে জীবাণু বেরিয়ে আসে। এই জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। আপনারা জানেন আইসিইউতে ভাইরাসের লোড অনেক বেশি থাকে। ফলে এটা যাদের দরকার তারা তো পাচ্ছে।

এখন প্রতিদিন যে হারে রোগী বাড়ছে তাতে অক্সিজেন সংকট হতে পারে কী?

এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে অক্সিজেন সংকট হবে না এটা আমি বলতে পারি না। এখন পর্যন্ত আমরা সমানে সমানে আছি। যতটুকু আমদানি হচ্ছে, যতটুকু উৎপাদন হচ্ছে তাতে একটা স্বস্তিকর অবস্থানে আছি। কিন্তু এর চেয়েও যদি আরো বাড়ে তাহলে সংকট হতে পারে। এটা মোকাবেলা করার জন্য আমরা কতগুলো পরিকল্পনা নিয়েছি। তার মধ্যে আমরা ৪০টি অক্সিজেন জেনারেটর কিনছি। একটা জেনারেটর বাতাস থেকে প্রতি মিনিটে ৫০০ এমএল অক্সিজেন জেনারেট করতে পারে। এটা পাওয়ারে চলে। কিছু হয়তো এ সপ্তাহেই চলে আসবে। কিছু আসতে দুই-তিন সপ্তাহ লাগতে পারে। আপনারা জানেন এগুলো প্রস্তুত থাকে না। অর্ডার করার পর তারা প্রস্তুত করে দেয়। এগুলো এত ভারি জাহাজে আনতে হয়। ফলে সেখানেও কিছু সময় চলে যায়। এছাড়াও ভারত থেকে ট্রেনের ট্যাংকারে করে অক্সিজেন আনা হচ্ছে। এখন সংক্রমণের যে গ্রাফ সেটা যদি উর্ধ্বমুখী হয় তাহলে পৃথিবীর বড় বড় দেশ পারেনি, আমরাও পারব সেটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি না।

অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম

আমরা এখন পর্যন্ত কত শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে পেরেছি?

এই মুহুর্তে সঠিক হিসাবটা আমি বলতে পারব না। তবে আমাদের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া উচিৎ।

কত দিনের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা আওয়ায় আনার পরিকল্পনা করেছে সরকার?

আপনারা তো দেখেছেন আমরা কীভাবে শুরু করেছিলাম। আমাদের যাত্রাটা সুন্দর ছিল। কেন ব্যাহত হয়েছে সেটাও আপনারা জানেন। প্রতিদিন প্রায় এক কোটি লোককে আমরা টিকা দিতে পারি। সেই সক্ষমতা আমাদের আছে। সেটা যদি বাদও দেই, ধরি এক লাখ বা দুই লাখ মানুষকে দিতে পারি। তাহলে তো যে দুই মাস চলে গেছে তাতে আমরা কত মানুষকে টিকা দিতে পারতাম। টিকা তো আমাদের কাছে ছিল না। সারা পৃথিবী জুড়েই টিকা নিয়ে ভীষণ রাজনীতি হয়েছে। এখন টিকা এসেছে আমরাও দিতে শুরু করেছি।

টিকা কূটনীতিতে কী আমরা ব্যর্থ হয়েছি?

ব্যর্থ বলব না। আমি বলব, অনেকে দেশের চেয়ে আমরা এগিয়ে আছি। আমরা যখন টিকা দেওয়া শুরু করেছি, অনেক দেশ তখন ভ্যাকসিনের ‘ভ' দেখিনি। আমাদের তো প্রধানমন্ত্রী ব্লাঙ্ক চেক দিয়েছেন। বলেছেন, যেখান থেকে পার, যেভাবে পার টিকা নিয়ে এস। এখন আপনি দেখেন কয়টা দেশে মর্ডানা, ফাইজার বা সিনোফার্মের টিকা গেছে? আমরা কিন্তু এগুলো কিনেছি। উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থে নয়, নিজেদের অর্থে। এখন পৃথিবী জুড়ে যদি টিকার হাহাকার থাকে তাহলে আমরা কী করতে পারি। আর ইন্ডিয়ার সঙ্গে আমাদের যে অবস্থাটা হয়েছে, আসলে নিজেদের বিপন্ন করে কোন দেশ তো আর আপনাকে টিকা দেবে না

শুধুমাত্র সেরাম ইন্সটিটিউটের উপর ভরসা করে থাকা কী সঠিক ছিল?

সবাই এই কথাটা বলছেন, কিন্তু শুরুতে আমাদের কাছে তো আর কেউ আসেনি। আমরা যাদের আহ্বান করেছিলাম তাদের কেউ আসেনি। বিপদের সময় মানুষ খড়কুটো পেলে সেটাই ধরার চেষ্টা করে, আমরা সেটাই করেছি। এখন চীনের ৬/৭টা কোম্পানি টিকা কেনার জন্য আমাদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে।

সিনোভ্যাক্স তো আমাদের এখানে পরীক্ষা করতে চেয়েছিল?

আমরাও তো রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু ওরা তো কো ফাইনান্সিং চেয়েছিল। আমাদের দেশের লোকের উপর পরীক্ষাও করব, আবার টাকাও দেবো, সেটা কাম্য ছিল না। আমরা তো তাদের বলেছি, টিকা আমরা কিনতে রাজি আছি। কিন্তু পরীক্ষা করলে এমনি করতে হবে।

ওরা তো একটা নির্দিষ্ট সময় দিয়েছিল, সেই সময়ের মধ্যে আমরা তো সিদ্ধান্ত দিতে পারিনি?

যে কোন সরকারি প্রক্রিয়াতে সময় লাগে। আজকে আমাকে ১০ কোটি টাকা দিলেই আমি সেটা খরচ করতে পারব না। আপনারা জানেন, অতীতে শুধু মুখের কথায় খরচ করার কারণে কী পরিমাণ ঝামেলাটা হয়েছে। সরকারি আইন কানুন মেনে কিনতে গেলে সময় লাগবে।

স্বাস্থ্য বিভাগের নানা সময়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে? এটা কী সমন্বয়ের অভাবে? না-কি অন্য কোন কারণে?

যখন এগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তখন তো আমি ছিলাম না। তাই এ বিষয়ে আমি কথা বলতে চাই না। আমরা তো এসব ব্যাপারে খুবই শক্ত অবস্থান নিয়েছি। এর মধ্যে কিট নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল, আমরা সোজা সেই প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে দিয়েছি। আমি বলব না, ভুল ত্রুটি হয়নি, ভুল ত্রুটি মানুষই করে। সেগুলো শুধরে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। আমাদেরও ভুল ত্রুটি হতে পারে। আপনারা ধরিয়ে দিলে আমরা সেগুলো শুধরে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই

পরিস্থিতি সামাল দিতে আপনারা ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করার যে পরিকল্পনা নিয়েছেন, সেটা কোন পর্যায়ে আছে?

আমরা সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহবান জানিয়েছি, তারা যেন এগিয়ে আসেন। তারা যদি আমাদের কিছু দেন তাহলে সেটা তারা বাজার থেকে সরাসরি কিনে আমাদের দিতে পারেন। কিন্তু আমাকে একটা সুই কিনতে গেলেও আমাকে নানা প্রক্রিয়া পার করে কিনতে হয়। তারা দিলে আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে পেয়ে যাব। সরকার তো করছে। কিন্তু সমাজের মানুষ এগিয়ে আসলে কাজটা সহজ হয়। এখন প্রক্রিয়া ফলো না করে আমি যদি কিনতে যাই তাহলে আমাকে জেলে যেতে হবে। ৩৩ বছর চাকরি করার পর কেন আমি জেলে যাব বলেন?