1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে সেন্সর অস্ত্রে অপছন্দের সিনেমা ঠেকায় সব দলই

১ জানুয়ারি ২০২১

সেন্সর বোর্ড একটি রাজনৈতিক মঞ্চ। মনে করেন বহু চলচ্চিত্র পরিচালক। গত ১০০ বছরে পরিচালকদের কম ঝক্কি সামলাতে হয়নি।

https://p.dw.com/p/3nR6n
ছবি: Getty Images/AFP/M. Kiran

বছরখানেক আগের কথা। আচমকাই ফোন করলেন অনীক দত্ত। মাঝেসাঝে কথা হয়। বেশিরভাগ সময়েই হোয়াটস্যাপে। আচমকা ফোনে খানিক অবাকই হয়েছিলাম। ফোন ধরতেই উত্তেজিত গলা অপরপ্রান্তে। ‘‘তোমরা কি কিছু দেখেও দেখতে পাও না! কীভাবে আমার ছবিটার পেছনে লেগেছে, চোখে পড়ছে না! কেমন সাংবাদিক তোমরা!’’

কলকাতার সব চেয়ে বড় বাংলা দৈনিক পত্রিকায় কাজ করি তখন। অনীক দত্ত ততদিনে ভূতের ভবিষ্যৎ বানিয়ে বাংলা বাজারে শুধু হিট নন, পরিচালকদের এলিট ক্লাবেরও মেম্বার। তার নতুন ছবি ভবিষ্যতের ভূত নিয়ে কিছু বিতর্ক চলছে শুনতে পাচ্ছিলাম। তবে রাজনৈতিক সংবাদদাতা সেসব বিষয়ের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। ফোন পেয়ে সম্বিত ফিরলো। একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতে যা বের হলো, তাকে কেঁচো খুঁড়তে ডায়নোসর বললেও অত্যুক্তি করা হয় না।

বরাবরই শ্লেষকে ছবির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন অনীক। নতুন ছবিতে সেই শ্লেষেই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসককেগুছিয়ে গাল পেড়েছেন তিনি। আর তাতেই বিপত্তি। কোনো হলে ছবি রিলিজ করা যাচ্ছে না। অনীকের অভিযোগ, সরকারের নির্দেশে কোনো প্রেক্ষাগৃহ ছবি নিতে চাইছে না। প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের বক্তব্য, তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না। আর বহু খুঁজেও এ বিষয়ে সরকারের কোনো বিবৃতি জোগাড় করা যায়নি।

এই ঘটনাকে কি সেন্সর বলা যায়? টেকনিকালি বলা যায় না। সেন্সর বোর্ড থেকে ছাড়পত্র পেয়েছিল ভবিষ্যতের ভূত। কিন্তু সরকার চায়নি, তাই ছবি কার্যত চালানোই যায়নি পশ্চিমবঙ্গে। না বললেই নয়, এই ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন কলকাতার সব চেয়ে বড় প্রোডাকশন হাউসের স্বনামধন্য মালিক। মুখ্যমন্ত্রীর তিনি একান্তই ঘনিষ্ঠ। শহরের অধিকাংশ হলের ডিস্ট্রিউবিউশন তার হাতে। তিনি না চাইলে, ছবি প্রেক্ষাগৃহ পর্যন্ত পৌঁছবেই না।

অধুনা পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারযা করছে, একদা তার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না বাম সরকার। ধনঞ্জয়ের ফাঁসিকে কেন্দ্র করে তখন উত্তাল কলকাতা। সেই বাজারে তৈরি হয়েছিল হ্যাং ম্যান নামের একটি ছবি। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পছন্দ নয়, তাই ওই ছবি দেখানো যায়নি শহরে। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে বাদ গিয়েছিল টরাস। লেনিনের বিষয়ে অপছন্দের সিন ছিল বলে। নবারুণ ভট্টাচার্যের গল্প হারবার্টের সিনেমারূপ দিয়েছিলেন পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। অতি বামপন্থা রয়েছে বলে সেই ছবিও আটকানোর চেষ্টা করেছিল বুদ্ধবাবুর সরকার। সরকারি প্রেক্ষাগৃহে ছবি রিলিজ করতে দেওয়া হয়নি।

ভারতে সেন্সরবোর্ড একশ বছর পেরিয়েছে। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশদের হাত ধরে কলকাতা, মুম্বই এবং রেঙ্গুনে প্রথম সিনেমাটোগ্রাফি অ্যাক্ট তৈরি হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল বোর্ড। পরবর্তীকালে সেই বোর্ডই সেন্সর বোর্ডে পরিণত হয়। রাজার পোশাক নিয়ে মজা করা যাবে না, পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের নিন্দেমন্দ করা যাবে না থেকে শুরু করে খুনখারাপি, চুমুটুমু-- এই সব কিছুর উপরেই নিয়মকানুন তৈরি করেছিল সেন্সর বোর্ড। বাস্তবে কি তা পালিত হয়েছে? এক কথায় উত্তর, কখনো একেবারেই হয়নি, আবার কখনো অতিমাত্রায় হয়েছে। ১৯৩৩ সালের ছবি 'কর্ম'তে চার মিনিট ধরে চুম্বন দৃশ্য দেখানো হয়েছিল। সেন্সর বোর্ড আটকায়নি। আবার ১৯২১ সালের ছবি 'ভক্ত বিধুর'এ হিরোর মাথায় গান্ধী টুপি এবং তিনি চড়কা চালান বলে ছাড়পত্র দেয়নি সেন্সর বোর্ড।

Syamantak Ghosh
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

গত ১০০ বছরে ভারতীয় সিনেমায় সেন্সরবোর্ড ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক মানসিকতা নিয়ে চালিত হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে ছবি ছাড়পত্র পেয়েছে অথবা পায়নি। এমনকি অশ্লীলতাও মাপা হয়েছে রাজনৈতিক নিক্তিতে। কোন লবির ছবি, প্রোডাকশন হাউসের সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক, পরিচালকের রাজনৈতিক মতাদর্শ-- এই সব কিছুই বিবেচিত হয়েছে সেন্সরবোর্ডে। কখনো ভারতীয় সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে, কখনো রাজনৈতিক অস্থিরতার ফিরিস্তি গেয়ে ছবির উপর খাঁড়া নেমেছে।

দীপা মেহতার ফায়ার ছবি নিয়ে তেমনই বিতর্ক রীতিমতো সাড়া ফেলেছিল গোটা দেশে। সেখানে নাকি বেনারসের সংস্কৃতিকেঅপমান করা হয়েছে। আবার রাজপুতরা ফুঁসে উঠেছিলেন পদ্মাবত ছবিটি নিয়ে। সবকিছুর পিছনেই রয়েছে রাজনীতির অঙ্গুলিনির্দেশ।

এমনও ঘটেছে, ফেস্টিভ্যালে প্রচুর পুরস্কার পাওয়া ছবি প্রেক্ষাগৃহে রিলিজ করতে দেওয়া হয়নি। সেন্সর বোর্ড যে পরিমাণ পরিবর্তন চেয়েছে, তা করলে গোটা ছবিটিই বদলে যাবে।

সেন্সর বোর্ডের আইন এখনো ব্রিটিশ আমলের। দেশের চলচ্চিত্র জগতের একটি বড় অংশ সেন্সর বোর্ডের বিরোধী। তারা একাধিকবার সেন্সর বোর্ড তুলে দেওয়ার পক্ষে কথা বলেছেন। অনেকেই বলেছেন, সেন্সর বোর্ডের কাঠামো বদলে ফেলা হোক। বাস্তবে তা হয়নি। বরং দেখা গেছে, যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সকলেই নিজেদের লোক বসিয়েছে সেন্সর বোর্ডে। সেন্সর বোর্ডও সেই অনুসারে সরকারকে তুষ্ট রেখেছে। আর যেখানে গিয়ে সেন্সর বোর্ড ছবি আটকাতে পারেনি, সেখানে সরকারের নিজস্ব মেশিনারি হলে ঢুকতে দেয়নি ছবি।