ভারতীয় বিচার বিভাগের এক বেনজির ইতিহাস
১৮ মে ২০১৭সুপ্রিম কোর্ট বনাম হাইকোর্টের আইনি মামলা নিয়ে অতীতে এমন নাটকীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল কিনা জানা নেই৷ কলকাতা হাইকোর্টের বর্তমান বিচারপতি সিএস কারনানের বিরুদ্ধে আদালত অবমানার অপরাধে সুপ্রিম কোর্টের সাত জন বিচারপতির এক ডিভিশন বেঞ্চ বিচারপতি কারনানকে সুপ্রিম কোর্টে হাজির হবার নির্দেশ দেয়৷ বিচারপতি কারনান তা গ্রাহ্য করেননি৷ উল্টে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদেরই তিনি তাঁর এজলাসে হাজির হতে বলেন৷ শীর্ষ আদালতের চূড়ান্ত অবমাননার দায়ে বিচারপতি কারনানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে সুপ্রিম কোর্ট৷ তারপর থেকে বিচারপতি নিখোঁজ৷ তাঁকে খুঁজে বের করে আদালতে হাজির করাবার জন্য কলকাতা পুলিশ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত৷ এখনও পুলিশ তাঁকে খুঁজে পায়নি৷ শোনা যাচ্ছে, তিনি নাকি চেন্নাইয়ে আছেন৷ আবার কেউ কেউ বলছেন, তিনি দেশ ছেড়েছেন৷
তিনি এখন কোথায় আছেন তা নিয়ে বিভ্রান্তিকর খবর ছড়ানো হচ্ছে বলে মনে করেন কারনানের আইনজীবীরা৷ তাঁরা মনে করেন, বিচারপতি কারনানের হাতে সাংবিধানিক দায়িত্ব আছে৷ তিনি আইনি পথেই এর মোকাবিলা করবেন৷ এসব যুক্তিতে রীতিমতো ক্ষুব্ধ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জেএস খেহরের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ৷ বিচারপতি কারনানের অস্বাভাবিক আচরনের জন্য তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে ডাক্তার পাঠানোর নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত৷ কিন্তু বিচারপতি কারনান তাঁর কলকাতার বাসভবনে ডাক্তারদের ঢুকতে দেননি৷
বিচারপতি কারনানকে গ্রেপ্তার হওয়া থেকে রেহাই দিতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলার দ্রুত বিচারের আর্জি জানান আইনজীবীরা৷ তাঁর তরফে মামলা চালানোর অধিকার দিয়ে বিচারপতি কারনানের সই করা একটি ওকালতনামা পেশ করেন তাঁর আইনজীবী৷ মামলাকে ঘিরে সুপ্রিম কোর্টে এক নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷ এক আইনজীবী চিত্কার করে বলতে থাকেন, ‘‘বিচারপতি কারনানকে ন্যায়বিচার দেওয়া হোক৷’’ বারংবার চিত্কার চেঁচামেচি করতে থাকলে ঐ আইনজীবীকে আদালত থেকে বের করে দেওয়া হয়৷ পাশাপাশি মামালার দ্রুত শুনানির সেই আর্জিও খারিজ করে দেয় শীর্ষ আদালত৷ ভারতের প্রধান বিচারপতি বলেন, তিনি সই করে থাকলে এখন তিনি কোথায় আছেন তা আদালতকে জানানো হোক৷ এরই মধ্যে বিতর্কিত বিচারপতি কারনান গোটা পরিস্থিতি জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদের স্পিকারকে৷ দেখা করতে চেয়েছেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে৷ তারপরই তিনি স্থির করবেন সুপ্রিম কোর্টে আত্মসমর্পণ করবেন কিনা৷
আইনজীবী মহল বিচারপতি কারনানের আচরণ এবং সুপ্রিম কোর্টের গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকাণ্ড নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত৷ একপক্ষ মনে করেন, সাংবিধানিক আদালতের একজন বর্তমান বিচারপতি তাঁর যোগ্য বিচার পাননি৷ ভারতীয় বিচারালয়ে এই ধরণের প্রথম ঘটনা এটি৷ বিচারপতি নিয়োগ কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ কলেজিয়াম যাঁকে নিয়োগ করেছিল, তাঁকেই জেলে পাঠাতে চেয়ে কী বার্তা দিতে চাইছে সুপ্রিম কোর্ট? আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহের মতো কারও কারও প্রশ্ন – সুপ্রিম কোর্ট চাইলে তাঁর ইমপিচমেন্টের জন্য সংসদের কাছে আর্জি জানাতে বাধা কোথায় ? অন্য পক্ষ মনে করে, বিচারপতি কারনান যেহেতু দলিত তাই তাঁর বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা৷ তাঁরা আরো মনে করেন, আইনি ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও হাইকোর্টের বিচারপতি কারনান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ সাত জন বিচারকের বিরুদ্ধে আদেশ জারি করে বড় ভুল করেছেন৷ তাঁর আরেকটি ভুল শীর্ষ আদালতের সমন বারংবার অগ্রাহ্য করা৷ তবে হ্যাঁ, ৩১শে মার্চ একবারই শুধু তিনি আদালতে মুখ দেখান৷ কিন্ত আদালত অবমাননার জন্য ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেন৷ সম্ভবত ভেবেছিলেন, তাঁকে শাস্তি দেবার ‘ঔদ্ধত্ব’ শীর্ষ আদালত দেখাবে না৷ কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন, ‘‘আদালত অবমাননার শাস্তি সাধারণ নাগরিক এবং বিচারপতি সবার ক্ষেত্রেই সমান৷ আইনের যিনি রক্ষক তিনি ভক্ষক হলে অন্যদের মতো আইনের বিধান তাঁর ওপরও প্রযোজ্য৷’’
এই ঘটনার সূত্রপাত গত ফেব্রুয়ারি মাসে৷ বিচারপতি কারনান ২০ জন বিচারপতিকে দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করে তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি তোলেন৷ এর পরেই সুপ্রিম কোর্টের সাত বিচারপতির বেঞ্চ নিজেরাই আদালত অবমাননার মামলা করেন৷ বিচারপতি কারনান অবসর নেবেন আগামী মাসে৷ এখনও তিনি নিখোঁজ৷ তাঁর শাস্তি অবসর গ্রহণের আগে, নাকি পরে কার্যকর হবে, সেটাই এখন দেখার৷ এই নিয়ে অবশ্য খবর প্রচারে মিডিয়াকে সংযত থাকতে বলেছেন সুপ্রিম কোর্ট৷