1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভাগাড়ের পশুর মাংসও তো খেয়েছি আমরা

গৌতম হোড়
গৌতম হোড়
১৭ মার্চ ২০২৩

কী খাইনি আমরা, ভাগাড়ের পশুর মাংস, কীটনাশক-ভর্তি ঠান্ডা পানীয়, ভেজাল বেবিফুড কিছুই তো বাদ নেই৷

https://p.dw.com/p/4Oovh
ভারতের তামিলনাড়ুর এক রেস্টুরেন্ট৷
ভারতের তামিলনাড়ুর এক রেস্টুরেন্টছবি: Creative Touch Imaging Ltd./NurPhoto/picture alliance

দিন কয়েক আগে অভিযোগ করেছিলেন ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় শেফ সঞ্জীব কাপুর৷ এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে যে খাবার দেয়া হয়েছিল, তা নিয়ে তিনি একটা টুইট করেছিলেন৷ সেখানে বলা হয়েছিল, এয়ার ইন্ডিয়া যে খাবার দিয়েছিল, তা হলো ঠান্ডা চিকেন টিক্কা, সামান্য বাঁধাকপি মেয়োনিজে মিশিয়ে স্যান্ডউইচ, তরমুজ, শশা, টমেটো ও ঝুরিভাজা দিয়ে স্যালাড৷ শুধু একটাই মন্তব্য করেছিলেন সঞ্জীব কাপুর৷ সেটা হলো ‘ওয়েক আপ এয়ার ইন্ডিয়া’৷ আর কিছু না বলে খাবারের ছবিগুলো  দিয়ে দিয়েছিলেন৷

সেলিব্রিটি শেফের এই টুইট নিয়ে হইচই পড়ে যায়৷ এয়ার ইন্ডিয়া এখন আর সরকারি হাতে নেই৷ একটি বেসরকারি সংস্থাকে বেচে দিয়েছে সরকার৷ তারা সঙ্গে সঙ্গে টুইট করে জবাব দেয়, ‘‘আপনার ফিডব্যাক আমাদের কাছে মহার্ঘ৷ আমরা মান বাড়াবার চেষ্টা করছি৷ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, পরের বার যখন আমাদের বিমানে উঠবেন, আপনার কোনো অভিযোগ থাকবে না৷’’ 

এখানে না হয় অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন শেফ অভিযোগ করেছেন বলে তুমুল হইচই হলো এবং বিমান কর্তৃপক্ষ নিজে থেকেই সতর্ক হয়ে ব্যবস্থা  নেয়ার কথা জানালেন৷  বিমানে তো পচা খাবার সরবরাহ করা হয়নি৷ খারাপ মানের খাবারও নয়৷ কিন্তু আমরা রাস্তাঘাটে ব্যাংয়ের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা রেস্তোরাঁ বা ফুটপাথের দোকানে যে সব জিনিস খাই, খেয়েই থাকি, সেখানে কি খাবারের মান ঠিক থাকে? না কি, ‘কোন খেলা যে খেলবে কখন’ -এর মতো, ‘কোন মাংস যে দেবে কখন’ গাইতে গাইতে আমরা ধসা-পচা সব জিনিস খেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলি, ওহ, অসাধারণ৷ মনটা ভরে গেল৷

খুব বেশিদিনের কথা তো নয়৷ বছর পাঁচেক আগের ঘটনা৷ কলকাতা কেঁপে উঠেছিল ভাগাড়ের পচা মাংস রেস্তোরাঁয় সরবরাহ করার কেলেঙ্কারি নিয়ে৷ ঘটনাটা কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার অথবা পুরসভার খাদ্য নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংস্থা বা কর্মীরা ধরেননি৷ ধরা পড়েছিল একেবারে আচমকা নেহাতই ঘটনাচক্রে৷ কলকাতার কাছে বজবজে বেশ কয়েকটি ভাগাড় আছে, যেখানে পশুর মৃতদেহ ফেলা হয়৷  একদিন ভোরের দিকে স্থানীয় মানুষ দেখেন রাস্তায় একটি গাড়ি কাদায় আটকে গেছে৷ সেখান থেকে কর্মীরা কিছু প্যাকেট নামাচ্ছেন, যার থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে৷ সেই মানুষজন পুলিশকে খবর দেন৷ পুলিশের জেরায় ওই গাড়ির লোকেরা স্বীকার করে, তারা ভাগাড়ের মাংস কেটে নিয়ে যাচ্ছিল এবং প্রায়ই তারা এই কাজটা করে৷ ওই মাংস নিয়ে গিয়ে কেমিক্যাল দিয়ে দুর্গন্ধ দূর করা হয়৷ তারপর কিছু ভালো মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে হিমায়িত করে দোকানে, রেস্তোরাঁয় সরবরাহ করা হয়৷

ভাবুন বিষয়টা৷ এরপর কলকাতার একটা কোল্ড স্টোরেজে তল্লাশি করে দুই টন পচা মাংস উদ্ধার করে পুলিশ৷ তারপর আরো কিছু জায়গা থেকে প্রচুর পচা মাংস উদ্ধার করা হয়৷ পুলিশের কর্তা জানিয়েছিলেন, ফুটপাথ বা ছোট রোল বা কাবাবের দোকানে তো বটেই, অনেক বড় বড় রেস্তোরাঁয় যেত ওই মাংস৷ কল্যাণীর একজন কমিশনার সহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷

তারপর? তারপর কিছুদিন কলকাতার মানুষ মাংস খাননি৷ চিকেন পর্যন্ত নয়৷ কারণ, পোলট্রি থেকে মরা চিকেন এনে বিক্রি করার চক্রও ধরা পড়েছে ততদিনে৷ তখন মানুষজন গর্জন করলেন, তাই তো বলি কী করে এত সস্তায় বিরিয়ানি দেয় দোকানগুলি? মানুষের স্মৃতিতে তো বেশিদিন বিষয়গুলো থাকে না৷ আজ আবার হইহই করে সব জায়গায় সস্তায় বিরিয়ানি, কাবাব সবই বিক্রি হচ্ছে৷ তারপর কি নিয়মিত খাবার পরীক্ষা করে দেখা হয়? নিন্দুকেরা এমন কোনো অভিযোগ অন্তত করেননি৷  ওই অপরাধীরা এখন কোথায়, তাও জানি না৷

আপনি এখন কলকাতা, দিল্লি-সহ ভারতের যে কোনো শহরে যান, মোমো বিক্রি হতে দেখবেন৷ দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের মতো জায়গায় গোটা কুড়ি মোমো বিক্রির দোকান আছে৷ তার দাম খুবই সস্তা৷ যে কোনো মুরগি বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করুন৷ তারা বলবে, ওই দামে চিকেন ভরে মোমো বিক্রি করা সম্ভব নয়৷ তাহলে বিক্রি হয় কী করে? নিন্দুকেরা বলে, চিকেন দিতে হবে, তার কী মাথার দিব্যি আছে৷ মুরগির নাড়িভুড়ি তো আছে৷ তা দিলেই বা ক্ষতি কী?

ভারতে খাবারের মান ঠিক করার জন্য, দেখার জন্য একটি সংস্থা আছে৷ ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অফ ইন্ডিয়া বা ফ্যাসাই৷ ২০১৭ সালে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বা ক্যাগ তার রিপোর্টে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও তাদের সংস্থা ফ্যাসাইয়ের তীব্র সমালোচনা করে বলেছিল, তারা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়ম-কানুন  ঠিকভাবে তৈরিই করে না৷ তাই এই সম্ভাবনা পুরোদমে আছে যে, বাজারে নিরাপদ নয় এমন খাবার বিক্রি হচ্ছে, উৎপাদনও হচ্ছে৷ কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরে মান বজায় রাখা সংক্রান্ত কোনো গাইডলাইনই নেই৷

তাহলে অবস্থাটা কী হতে পারে? খাবারের মান-টান নিয়ে কথা বলে কী লাভ? যা পাওয়া যাচ্ছে, সেটাই আনন্দ করে খাও, খেয়ে যাও৷ শরীর থাকলে তো খারাপ হবেই৷

আরেকটা কাহিনির দিকে নজর ফেরানো যাক৷ সম্ভবত ২০০৬ সাল৷ সংসদ উত্তাল হলো একটা অভিযোগ নিয়ে৷ ভারতে ঠান্ডা পানীয়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক আছে৷ সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভারয়নমেন্ট (সিএসই)-র সমীক্ষায় তা ধরা পড়েছে৷ হইচইয়ের পর একটি বিদেশি ও দেশি সংস্থার পরীক্ষা রিপোর্ট এল, ঠান্ডা পানীয়র কীটনাশক সীমার মধ্যে আছে৷ এর ১৬ বছর পর ২০২২-এ আউটলুকের রিপোর্ট জানাচ্ছে, সিএসই এবং পলিউশন কন্ট্রোল ল্যাবরেটরির রিপোর্ট বলছে, দিল্লির ১২টি ঠান্ডা পানীয়র মধ্যে সীমার থেকে অনেক বেশি কীটনাশক আছে৷ এমনকী খাবারের জলের বোতলের মধ্যেও কীটনাশকের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি৷

তাতে অসুবিধা কোথায়! আমরা তো মন্বন্তরে মিরিনি, মারী নিয়ে ঘর করি৷ তাই ওসব রিপোর্ট মাঝেমধ্যে  আসে৷ মন সামান্য বিক্ষুব্ধ হয়৷ তারপর আমরা আবার সব ভুলে যাই৷ একটু অসময়ে বাজারে গেলে দেখি পটল রং দিয়ে সবুজ করা হচ্ছে তাজা দেখানোর জন্য, কোন জাদুকরের ছোঁয়ায় সব তরমুজই ভিতরটা এখন গাঢ় লাল রংয়ের (নিন্দুকেরা বলে এ সব না কি ইঞ্জেকশনের কেরামতি), ফলটল কার্বাইড দিয়ে পাকানোর অভিযোগ তো বহুদিনের৷ এমনকী আপেল চকচকে দেখানোর জন্য কাপড়ে একটু মোম ঘষে তা আপেলের উপর বুলিয়ে দেয়া হয়৷

কোন কেমিক্যালেযে কী ম্যাজিক হয়, তা আমাদের অজানা৷ কেমিক্যাল দিয়ে পচা মাংসের দুর্গন্ধ ঢেকে সেগুলি যখন, হোটেল-রেস্তোরাঁয়পৌঁছে দেয়া হয় এবং মানুষও কিছু টের না পেয়ে তা দিনের পর দিন খেয়ে যান, তখন তো সবই সম্ভব৷ দিল্লিতেই তো কতবার দুধের মধ্যে রাসায়নিক মিশ্রিত জল ঢেলে কতজন ধরা পড়েছে৷ ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি দুধে পিটুলি গোলা মেশানো হয়৷ আপ্তবাক্য হলো, গোয়ালারা দুধে জল মেশাবেই৷  সে জল তো আর মিনারেল বা আরও-র জল হবে না৷ একসময় তেলে শেয়ালকাঁটা মেশানো নিয়ে প্রচুর হইচই হয়েছে৷ বেবিফুডেও ভেজাল ধরা পড়েছে৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

তাহলে ঘটনাটা তো এটাই দাঁড়ালো, এসব ভেজাল-টেজাল, দুনম্বরি সবকিছু থাকবে, তা বন্ধের জন্য সংস্থা থাকবে, তাদের কর্মীরা মাসে মাসে বেতন পাবেন, মাঝেমধ্যে হইচই হবে, তারপর তা ধামাচাপা পড়ে যাবে বা ধামাচাপা দেয়া হবে৷ সব যেমন ছিল, তেমনই চলতে থাকবে৷ আমার পরিচিত এক সাংবাদিকের কথা মনে পড়ছে৷ কলকাতার একটি বাংলা কাগজের সেই সাংবাদিক একদিন উত্তেজিত হয়ে জানালো, যা একখানা রিপোর্ট করেছি, তাতে এরপর প্লাস্টিকের বোতলে জল খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে৷  কারণ, ওই বোতল যে স্বাস্থ্য়ের পক্ষে কতটা খারাপ, তা তথ্যপ্রমাণ দিয়ে সে লিখেছিল৷ বিকেলে সে গিয়ে দোকানে দকানে ঘুরে দেখেছিল, বোতলের বিক্রি কমেছে কি না? পরে সে হতাশ হয়ে দেখেছিল, একটা বোতলের বিক্রিও কমেনি৷ সকালের কাগজ দুপুরেই তো ঠোঙা হয়ে য়ায়, আজকের বিতর্ক কাল মানুষ ভুলে যায়৷ ফলে যা চলছে, তা চলবে৷ ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী গাড়িতে বেল্ট না লাগালে একশ পাউন্ড জরিমানা দিতে হয়৷ খাবারের মান খারাপ হলে কোম্পানিকে এত বেশি ক্ষতিপূরণ দিতে হয় যে, তারা রীতিমতো ভয়ে থাকে৷ কিন্তু আমরা এই উপমহাদেশের মানুষ তো৷ এখানে ওই সব ঘটনকে স্বর্গরাজ্যের কাহিনি মনে হয়৷ আমাদের এখানে কলকাতাকে কত সহজে লন্ডন বানিয়ে দেওয়া যায়, গুড়গাঁওকে সিঙ্গাপুর৷ সব ম্যাজিকই কাজ করে৷ মানুষকে বোকা বানানো যে খুবই সোজা৷ তার জন্য কোনো কেমিক্যালেরও দরকার হয় না৷