1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বোরকা নিষিদ্ধকরণ নিয়ে বিতর্ক

পায়েল সামন্ত ভারত
৪ মে ২০১৯

শ্রীলঙ্কায় বোরকা নিষিদ্ধ হওয়ার পর একই দাবি উঠেছে ভারতে৷ জঙ্গিরা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালাতে বোরকা ব্যবহার করছে বলে অনেকের মত৷ এই দাবির বিরুদ্ধেও উঠেছে আওয়াজ৷ ফলস্বরূপ বিতর্কের কেন্দ্রে বোরকা৷

https://p.dw.com/p/3HuBD
ছবি: DW/P. Samanta

ভয়াবহ ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ও রক্তপাতের পর শ্রীলঙ্কার সরকার বোরকা নিষিদ্ধ করেছে৷ তাদের এই পদক্ষেপের পর নির্বাচনি মরসুমে ভারতেও বিতর্কের কেন্দ্রে এসে পড়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীর পোশাক বোরকা৷ দিল্লিতে ক্ষমতাসীন বিজেপির শরিক শিবসেনা সবার প্রথমে দাবি তুলেছে– ভারতে বোরখা নিষিদ্ধ করতে হবে৷ তারা মনে করে, বোরখার আড়ালকে জঙ্গিরা আত্মগোপন করার প্রয়োজনে ব্যবহার করছে, এতে জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে৷ হিন্দু জাতীয়তাবাদের সমর্থক হলেও বিজেপি অবশ্য এই দাবিকে সমর্থন করেনি৷ কিন্তু তাদের প্রার্থী সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর শিবসেনার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন৷ এবার মধ্যপ্রদেশের ভোপাল কেন্দ্রে লড়ছেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী প্রজ্ঞা৷ তাঁর বক্তব্য, দেশের স্বার্থ সবার উপরে, তার জন্য প্রয়োজনে সব কিছুই করা যায়। তিনি মনে করেন, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিতে হবে, বিমানবন্দরে কিংবা বিদেশ সফরে গেলে বোরখা সরাতে হয়, দেশের প্রয়োজনে তা নিষিদ্ধ হলে আপত্তি থাকা উচিত নয়৷ 

‘ধর্মীয় নেতারা অনেক কিছু চাপিয়ে দিতে চায় ধর্মের নামে’

পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের সূত্রে এই রাজ্যে জঙ্গি তৎপরতার ছবি সামনে এসেছিল৷ সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে মহিলাদের যোগও পাওয়া গিয়েছে৷ জেএমবি-র গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য মিললেও আইএস আতঙ্কের কারণ এখনো মেলেনি৷ প্রাক্তন পুলিশকর্তা সন্ধি মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষ জঙ্গি কাজকর্মে জড়িত থাকে না, তারা হিংসার শিকার হয়। তাই বোরখা বন্ধ করলে জঙ্গি তৎপরতা কমবে, এতে ভাবার কিছু নেই৷ পশ্চিমবঙ্গে আইএস বা জেএমবি-র হামলার বিরাট কোনো সম্ভাবনা এই মুহূর্তেই হয়তো নেই, তবু সতর্ক থাকা ভালো৷'' এর থেকে নারীমুক্তির প্রশ্নটিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন সন্ধি৷ তিনি বলেন, ‘‘ধর্মীয় নেতারা অনেক কিছু চাপিয়ে দিতে চায় ধর্মের নামে৷ তাহলে সতীদাহ চালিয়ে যেতে হতো৷ ধর্মের নামে বিভেদ সৃষ্টি করাটা বন্ধ করতে হবে৷ সাধারণ মানুষদের ক্ষতি করে এসব৷ যে কোনো দেশে সেদিক থেকে বোরখা নিষিদ্ধ করার উদ্যোগকে সমর্থন জানাই৷''

বোরকা নিছকই একটা পোশাক নয়, একটি সম্প্রদায়ের পরম্পরা ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে৷ রাজ্যের সংখ্যালঘু জনতার কাছে ধর্মীয় অনুষঙ্গ স্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে৷ যদিও সেখানেও কট্টর ও উদারপন্থিদের মধ্যে বিভাজন রয়েছে৷ বর্ধমান জেলার আউশগ্রামের ব্রাহ্মণডিহি মসজিদের ইমাম শেখ নবি হাসান বোরকা নিষিদ্ধ করাকে সরাসরি ‘হারাম' বলে আখ্যা দিলেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শরিয়ত অনুযায়ী মহিলাদের তিনটি অংশ ছাড়া বাকিটা পুরুষের সামনে অনাবৃত থাকা উচিত নয়৷ অর্থাৎ হাত, পা, মুখ ব্যতীত চতুর্থ অংশ বেপর্দা রাখা যাবে না, এটা ইসলামের নীতি৷ পুরুষদের ক্ষেত্রে নাভির নীচ থেকে আবৃত রাখতে হবে৷'' বোরখা বাতিল হলে মুসলিমদের উপর ‘অবিচার' হবে বলে তাঁর মত৷ তবে সবাই তা মনে করছেন না৷ মুর্শিদাবাদ জেলার রানিনগরের কোমনগর হাই মাদ্রাসার শিক্ষিকা শবনম পরভেজ জোর করে কিছু করানোর বিরুদ্ধে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি বোরকা ব্যবহার করি না৷ অনেকেই করেন না৷ অর্থাৎ শরিয়ত সবাই অনুসরণ করছেন, এমনটা নয়৷ কিন্তু, কারো যদি বোরকা পরতে সমস্যা না হয়, তার উপর নয়া নিয়ম চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়৷ বোরখা বন্ধ হলেই কি অপরাধমূলক সমস্যাগুলো মিটে যাবে?''

সংখ্যালঘু মহিলাদের পরের প্রজন্মের ভাবনা আরো প্রগতিশীল৷ শবনমের মাদ্রাসার দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী সান্তানুর আহসানিয়া অকটপে বলে, ‘‘আমিও বোরকা পরি না৷ তবে জানি, ইসলামে বোরকা পরার কথা বলা আছে৷ কেউ যদি পরে, তাহলে কিছু বলার নেই৷ কিন্তু, আমার দেশ সবার উপরে৷ দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে বোরকা নিষিদ্ধ করতে হলে সেটা ঠিক৷'' ইতিমধ্যে ভারতের সংখ্যালঘুদের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বোরকা নিষিদ্ধ করেছে৷ কেরলের কোঝিকোড় শহরের মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো ছাত্রী বোরকা পরতে পারবেন না৷ এই প্রতিষ্ঠানের অধীন ৭২টি স্কুল ও ৩৫টি কলেজে এক লক্ষ পড়ুয়া রয়েছেন৷ 

‘সাধারণ মানুষ জঙ্গি কাজকর্মে জড়িত থাকে না, তারা হিংসার শিকার হয়’

ভারত সরকার মুসলিমদের তিন তালাক প্রথা বিলোপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ এই উদ্যোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলছে বিরোধীরা৷ আবার অনেকের মত, পুরুষতন্ত্রের জাঁতাকল থেকে নারীকে মুক্তি দেবে এই চেষ্টা৷ ধর্মের নামে বোরখার নিদানকে পুরুষতন্ত্র অটুট রাখার কৌশল বলে মনে করছেন সমাজকর্মী, অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘো্ষ৷ ইমামের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, "নারীকে আবৃত রাখার কথা যে পুরুষ বলে, তার সবার আগে ঘরে বন্ধ থাকা উচিত৷ তবে বোরকা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়৷ এখন জঙ্গি হামলা প্রসঙ্গে সেটা সামনে এসেছে৷ সন্ত্রাসবাদের চেয়ে নারীমুক্তির বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বক্তব্যে৷ তিনি টুইট করেছেন, ‘‘বোরকা নিষিদ্ধ করলে জঙ্গি কার্যকলাপ বন্ধ হবে না ঠিকই, কিন্তু নারী মুখহীন শবের মতো বেঁচে থাকার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে৷''

ভারতের জনসমষ্টির মাত্র ১৪ শতাংশ মুসলিমের একটি অংশের পোশাক নিষিদ্ধ করলে দেশ সুরক্ষিত হবে, এটা মানতে চান না ভারতীয় কবি, গীতিকার জাভেদ আখতার৷ ভারতে জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের বেশি হিন্দু ধর্মাবলম্বী৷ কোনো কোনো গোষ্ঠীর হিন্দু মহিলারাও মুখ আবৃত রাখেন৷ রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, বিহারে শাড়ির আঁচল মাথার উপর থেকে নামিয়ে মুখ ঢেকে রাখেন তাঁরা৷ জাভেদ আখতারের বক্তব্য, ‘‘ইরাকেও মহিলারা বোরকা পরেন না, তাহলে ভারতে পরবেন কেন? আমার পরিবারের কেউ পরেন না৷ তবে বোরকা নিষিদ্ধ হলে, নির্বাচন শেষ হওয়ার আগে রাজস্থানে ঘুঙ্ঘট (ঘোমটা) নিষিদ্ধ করা হোক৷''