1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বৈষম্যের শিকার ক্রীড়াঙ্গনের নারীরা

২ জুলাই ২০১৮

খেলাধুলার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভালো করছেন নারীরা৷ পুরুষদের সমান পৃষ্ঠপোষকতা বা সুবিধা তো দূরের কথা, বৈষম্য বিস্তর৷ সে কারণে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এগিয়ে যেতে পারছেন না তাঁরা৷

https://p.dw.com/p/30bXQ
Bangladesch Sport Persönlichkeiten
ছবি: Mir Farid

প্রসঙ্গটি আরেকবার এলো বাংলাদেশের নারীরা যখন এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টির মুকুট পরলেন৷ তাঁদের হাত ধরেই ক্রিকেটের একমাত্র শিরোপাটি শোভা পাচ্ছে বিসিবি-র শিরোপাঘরে৷

আফগানিস্তানের কাছে লজ্জার হার নিয়ে যখন দেশে ফিরলেন পুরুষ ক্রিকেটাররা, তখন এই মেয়েরাই হাত ধরে টেনে তুললেন দেশের ক্রিকেটকে৷ জ্বালিয়ে রাখলেন আশার আলো৷ ঠিক তখনই প্রশ্ন এলো, এই মেয়েরা আসলে প্রতিদানে কী পাচ্ছেন?

বিসিবির তথ্য বলছে, বর্তমানে বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ১৭ জন নারী ক্রিকেটারের বেতন সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা! আর ছেলেদের ক্রিকেটে সর্বনিম্ন বেতন প্রায় লাখ টাকা৷

এখানেই শেষ নয়৷ ছেলেদের জাতীয় লিগের প্রথম স্তরে ম্যাচ ফি ২৫ হাজার টাকা৷ দ্বিতীয় স্তরে ২০ হাজার টাকা৷ মেয়েদের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ম্যাচ ফি এক হাজার টাকা৷ তাও সম্প্রতি বাড়ানো হয়েছে৷

প্রশ্ন হলো, ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের প্রতি বৈষম্য কি ক্রিকেটেই শুধু? চোখ বন্ধ করে বলা যায়, অবশ্যই নয়৷ ফুটবল, বাস্কেটবল, অ্যাথলেটিক্সসহ সবক্ষেত্রেই শুধু আর্থিকভাবেই নয়, সামাজিকভাবেও বৈষম্যের শিকার নারীরা, যার শুরু পরিবার থেকেই৷ যেমন, ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের মেয়েরা৷

ফুটবল খেলতে গিয়ে তাদের প্রথমেই বাধা আসে পরিবারের কাছ থেকে৷ পরিবারের সদস্যরা ভেবেছিলেন, ফুটবল খেললে মেয়ের আর বিয়ে হবে না৷ তার ওপর দু'বেলা খাবারের জোগানই যেখানে বাহুল্য, সেখানে ফুটবল খেলা তো আকাশ-কুসুম কল্পনা৷ অনেক প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এই মেয়েরা আজ দেশ ও দেশের ফুটবলের মুখ উজ্জ্বল করেছেন৷ টিম টিম করে জ্বলতে থাকা বাংলাদেশ ফুটবলকে আলো দেখিয়েছেন এরা৷ অথচ এ দেশে মেয়েদের পেশাদার ফুটবলের জরাজীর্ণ অবস্থা৷

শুধু ক্রিকেট বা ফুটবল নয়, যেসব মেয়ে সাঁতার, অ্যাথলেটিক্সে সুনাম কুড়িয়ে এনে দেশের মুখ আলো করছেন, হয়ত নিজের ঘরে আলো জ্বালাবার সামর্থ্যটুকু তাঁদের নেই৷

এ বিষয়ে সদ্য এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট জেতা বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সদস্য রুমানা আহমেদের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ এই সময় তিনি তাঁর ক্রিকেটার হিসেবে উঠে আসার পথে অতিক্রম করা বাধাগুলোর কথা জানান৷ ‘‘আমি আমাদের বাড়ির উঠোনে ক্রিকেট খেলতাম৷ সেখান থেকেই মনে হলো যে, একদিন আমিও ক্রিকেট খেলবো৷ কিন্তু যেহেতু মুসলিম দেশ, তার ওপর মেয়েরা ক্রিকেটের মতো এত কঠিন একটা গেম খেলবে, তা মেনে নিতে পারছিলেন না অনেকে,'' বলেন রুমানা৷

Rumana Ahmed Cricket - MP3-Stereo

তিনি জানান, আশেপাশের মানুষের সমালোচনা তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে সহ্য করতে হয়েছে৷ ‘‘আশেপাশের মানুষ, প্রতিবেশীরা সমালোচনা করতো৷ যেহেতু ক্রিকেটের ড্রেস পরতাম আর খেলা শেষ করে আসতে দেরি হতো, অনেকে কানাকানি করতো৷ বলতো, কী দরকার ক্রিকেট খেলার৷''

তবে পরিবার তাঁকে সহযোগিতা করেছে বলে জানান রুমানা৷ সাফল্য পেলেও ক্রিকেটে মেয়েদের অবস্থা তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি, বলে মনে করেন তিনি৷ ‘‘আমরা ক্রিকেট খেলছি দশ বছর হয়ে গেছে৷ কিন্তু দশ বছরে যেভাবে ক্রিকেটারদের আসার কথা, তেমনভাবে আসছে না৷ যেমন আমি খুলনাতে লোকাল ক্রিকেট প্র্যাকটিস করি পিলু স্যারের কাছে৷ আগে আমরা ২০ থেকে ৩০ জন একসঙ্গে প্র্যাকটিস করতাম৷ এখন সেখানে হাতে গোনা দশ-বারো জন প্র্যাকটিস করে৷ তার মানে, উলটো কমছে৷ কোথাও কোথাও হয়তো একটু বেড়েছে৷ কিন্তু সেভাবে বাড়েনি,'' বলেন তিনি৷

বেতন বৈষম্যের বিষয়ে রুমানা জানালেন, বোর্ড বেতন বাড়িয়েছে একধাপ৷ হয়ত আরো বাড়াবে৷ তবে তিনি ভাবছেন না এসব বিষয়ে৷ তবে কষ্ট পান মাঝে মাঝে মেয়েদের আর্থিক অবস্থা দেখে৷

‘‘পরিশ্রম কিন্তু মেয়েরা কম করছে না৷ কিন্তু দেখেন, আমাদের ভাইয়ারা অনেকেই অবস্থাপন্ন পরিবার থেকে আসেননি৷ কিন্তু খেলাধুলা করে তাঁরা তাঁদের জীবন পরিবর্তন করে ফেলেছেন৷ অথচ মেয়েদের জীবনে কিন্তু খেলে কোনো পরিবর্তন আসেনি৷ তারা কষ্টই করে যাচ্ছে৷''

মেয়েদের জন্য ক্রীড়াঙ্গনের পরিবেশ খুব একটা বদলায়নি বলেই জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘নারীদের জন্য আলাদা কোনো অ্যাকাডেমি নেই৷ নেই আলাদা সুযোগ-সুবিধা৷ তাই অনেকেই খেলতে আসতে পারছে না, তাদের প্রতিভা সবাইকে দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে না৷''

শুধু ক্রিকেট নয়, অন্যান্য ডিসিপ্লিনের অবস্থাও একই বলে জানালেন রুমানা৷ তাঁর কথার মিল পাওয়া যায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণের সঙ্গে৷ ডয়চে ভেলেকে মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেন, ‘‘জাপান-কোরিয়ার মতো দেশে ৭০-৮০ টা অ্যাকাডেমি আছে৷ সেখানে আমাদের একটিও অ্যাকাডেমি নেই৷''

Mahfuja Kiron UP - MP3-Stereo

মাহফুজা বাংলাদেশ থেকে ফিফার প্রথম সদস্য৷ এখন রাশিয়াতে ফিফার হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন৷ সেখান থেকে ফোনে ফুটবল নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের ফুটবল পিছিয়ে থাকার ক্ষেত্রে মূল কারণ অর্থের অভাব৷ ফুটবল কত এক্সপেন্সিভ গেম! সরকারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো সাপোর্ট পাই না৷ আমাদের স্পন্সরের ওপর নির্ভর করতে হয়৷ অথচ বিশ্বজুড়ে দেশগুলোর সরকার ফুটবলের পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে৷ সেখানে আমরা বছরে আট দশ কোটি টাকাও খরচ করি না৷ তাহলে কীভাবে এগুবে, বলেন!''

তবে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল নিয়ে আশাবাদী তিনি৷ ‘‘বাংলাদেশের নারী ফুটবল অনেক নতুন৷ এশিয়াতে যেসব দেশ নারী ফুটবলে সমৃদ্ধ, যেমন জাপান, কোরিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, তারা কিন্তু অনেক পুরনো৷ এমনকি ভারতের নারী দলও  ৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সি৷ সেদিক থেকে আমাদের নারী ফুটবলের বয়স ১০ বছর৷ সেদিক থেকে আমরা অনেক এগিয়েছি৷''

স্কুল পর্যায়ে মেয়েশিশুদের নিয়ে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেন তিনি৷ ‘‘আগে একটি টুর্নামেন্ট করতে হলে মেয়েদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের বাবা-মা, স্থানীয় কমিউনিটি লিডারদের সঙ্গে কথা বলতে হতো৷ তাঁদের বোঝাতে হতো৷ এখন বঙ্গমাতায় খেলা বাধ্যতামূলক হওয়ায় সেই কষ্ট অনেক কমে গেছে৷''

তিনি মনে করেন, যদি মেয়েদের ফুটবলে অর্থায়নে সরকার ও স্পন্সরদের সহযোগিতা পাওয়া যায়, তাহলে বিশ্ব পর্যায়ে বাংলাদেশের মেয়েরা খুব দ্রুত আরো উন্নতি করবে৷

ভারোত্তলনের কোচ শাহরিয়া সুলতানা সুচিও জানালেন অর্থাভাবের বিষয়টি৷ খেলাধুলায় অনুরাগী পরিবারের মেয়েরাই মূলত আসেন এই ডিসিপ্লিনে৷ এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী থেকেও মেয়েরা আসেন৷ কারণ, সেখানে তাঁরা চাকরি করেন৷ তাই চালিয়ে যেতে পারেন৷

Shahria Shuchi - MP3-Stereo

‘‘মেয়েরা অনেকেই ঝরে যায়৷ তার কারণ, এই খেলায় খাবারের বিষয় আছে৷ বেশিরভাগ মেয়েই আসে অসচ্ছল পরিবার থেকে৷ কিন্তু তারা সেটি ধরে রাখতে পারে না৷ তাই পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সম্ভব নয়৷''

নারী কোচ হিসেবেও কাজ করতে গিয়ে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন বলে জানান তিনি৷ ‘‘আমাদের কাজ করার জায়গাটা অত সহজ না৷ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়৷'' ডয়চে ভেলেকে ফোনে বলছিলেন তিনি৷

যোগ্যতা থাকার পরও মেয়েদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না বলে মনে করেন সুচি৷ ‘‘আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি যে, যেসব নারী বিভিন্ন চেয়ারে বসে আছেন, তাঁরা যে কতটা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কাজ করছেন তা সবাই জানেন না৷ ওপর থেকে দেখে মনে হয় বা অনেকে হয়তো বলবেন নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে৷ কিন্তু সেটা আইওয়াশ৷ এখনো আমাদের মা-বোনেরা ঘরে যেমন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, ক্রীড়াজগতেও তাই৷'' কেবল নারী বলেই অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি৷

শুধু তাই নয়, অনেক ডিসিপ্লিনে নিয়মিত বেতন বলতে কিছু নেই৷ এছাড়া অবকাঠামোর অভাব তো আছেই৷ এই তিন নারীই মনে করেন যে, কোচই হোক, খেলোয়াড়ই হোক, নারীদের কাজের প্রচার পুরুষদের তুলনায় অনেক কম হয়৷ নানাবিধ সমস্যার মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হয়৷

তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে বলে মনে করেন মাহফুজা আক্তার কিরণ৷ তিনি বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিনের কথা উল্লেখ করে বলেন, সভাপতি নারীদের শুধু নয়, সার্বিকভাবে ফুটবলকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন৷ তবে অন্য ডিসিপ্লিন নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি৷

তারপরও নারীরা এগিয়ে যান৷ সুনাম বয়ে আনেন দেশের জন্য৷ রুমানার ভাষায়, ‘‘বৈষম্য আছে৷ বাংলাদেশে নারী পুরুষের এই বৈষম্য কাটতে সময় লাগবে৷ তবে আমরা সেটি নিয়ে চিন্তা করছি না৷ আমরা লড়াই করছি দেশের জন্য৷ এবারো যেমন এশিয়া কাপে যাওয়ার আগে চিন্তা ছিল যে, দেশের জন্য কিছু করতে হবে৷''

প্রতিবেদনটি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকলে লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য