বৃক্ষ বাঁচাতে তৃণমূল পর্যায়ে আন্দোলন বাংলাদেশে
২১ জানুয়ারি ২০১১চারিদিকে নানা কোলাহল৷ এই কোলাহলের মাঝে আমাদের গাড়ি এসে পৌঁছালো আরিচা ঘাটে৷ পদ্মা নদীর নীলচে পানি৷ ফেরি লঞ্চ, কুলি মজুর আর ফেরিওয়ালাদের ডাকাডাকি৷ যাবো গোয়ালন্দ৷
গোয়ালন্দের একসময় পরিচিতি ছিল ইলিশ মাছ আর স্টিমার ঘাটের জন্য৷ এখন অবশ্য ইলিশ মাছের দেখা খুব একটাও পাওয়া যায় না৷ আর ইস্টিমার! সে তো উঠে গেছে অনেক আগেই৷
ফেরিতে অনেক বাস ট্রাকের সঙ্গে চড়ে বসলাম৷ নদীর পানির মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় একটু একটু করে পিঠ উঁচু করে বের করে আছে চর৷ নদীর নাব্যতা অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে এখানে৷ তারপরও চলতে হবে, আর তাই বছর জুড়েই চলছে ড্রেজিং৷
একটা সময় ছিল যখন গোয়ালন্দ ছিল বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার মতো সবুজ৷ ফেরি থেকে দেখা যাচ্ছে বিরান গোয়ালন্দ৷
সরকারি হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছে সবমিলিয়ে শতকরা ১৬ ভাগ বনভূমি৷ তবে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বাস্তবে বনাঞ্চলের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ ভাগের বেশি নয়৷ বেসরকারি হিসেবে অবশ্য বলা হয় দেশে এখন ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বনভূমি রয়েছে৷ সংরক্ষণের অভাবে অনেক ঘন অরণ্যও আজ বিরানভূমিতে পরিণত৷ সংঘবদ্ধ চক্র বনের গাছপালা উজাড় করেই ক্ষান্ত হয়নি জায়গা-জমি পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে৷ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করার কারণে বিশ্বের বহু বিচিত্র প্রাণী ও পাখি হারিয়ে গেছে৷ কেউ কি এ নিয়ে কোন কাজ করছে না?
গোয়ালন্দ বাজার সংলগ্ন শহীদ মিনারের পাশে আছে একটি সংগঠন৷ নাম গোয়ালন্দ সম্মিলিত নাট্যদল৷ তারা পথনাটক করে জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছে৷ এই সংগঠনের নেতা জালালুর রহমানের সঙ্গে কথা হলো সেখানকার একটি খোলা প্রান্তরে৷ পাখির কিচিরমিচির ছিল সর্বত্র৷ তিনি জানালেন, মানুষকে সচেতন করতে আমাদের সংগঠন কাজ করছে৷ আমাদের সংগঠনের আঠারো জন সদস্য সকলে এই প্রত্যয় নিয়ে কাজ করছে৷ পথ নাটক করে মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে আমাদের বক্তব্য৷ আমরা বলছি এক একটি গাছ এক একটি অক্সিজেন ফ্যাক্টরি৷ নিজের জন্য বৃক্ষ রোপণ করুন৷ বাঁচান দেশ এবং মানুষ কে৷
তাঁকে প্রশ্ন করি মানুষ কি সচেতন হচ্ছে? তিনি জানালেন, ফলাফল আসতে শুরু করেছে৷ প্রতি বর্ষায় মানুষ নতুন নতুন গাছ লাগাচ্ছে৷ এই গাছ একদিন বড় হবে, সবুজ হবে পুরো দেশ৷
পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশ বিপর্যস্ত দেশ৷ সাধারণভাবে পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার্থে কোনো দেশের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি দরকার৷ বাংলাদেশের মতো দেশে মোট কমপক্ষে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ থাকা বনভূমি অপরিহার্য৷ কিন্তু বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ৷ ১৯৭১ সালেও এই বনভূমি ১৭ শতাংশ ছিল৷ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অব্যাহত লুটপাটের ফলে এটা বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে৷ বর্তমানে দেশে মাথাপিছু বনভূমির পরিমাণ ০.০২২ হেক্টর৷
প্রতিবছর উজাড় হয়ে যাচ্ছে বনভূমি৷ এই হার ৩.৩ শতাংশ৷ সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, শালবন, চকরিয়া, কক্সবাজার, ইত্যাদি বনাঞ্চল একে একে উজাড় হয়ে যাচ্ছে৷
ষাটের দশক থেকে নোয়াখালীর দক্ষিণ উপকূলে ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলবাসীদের বাঁচানোর জন্য সৃষ্টি করা হয় উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী৷ সে সবুজ বেষ্টনী আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন৷ চর মজিদ, চর লক্ষ্মী, রামগতির এক ব্যাপক এলাকার বনভূমি উজাড় করে বসতি গড়ে উঠেছে৷ রাবার বাগান ও ইউক্যালিপটাস জাতীয় বিদেশি গাছ লাগানোর নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার বছরের রেন ফরেস্ট ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ বনবিশেষজ্ঞদের৷ সুন্দরবনের অবস্থাও তথৈবচ৷ দিনাজপুরের ঐতিহ্য শালবনের আর দেখা মেলেনা৷ তাই বৃক্ষপ্রেমিরা বলছেন, আসুন সকলে এক হই, বৃক্ষ রোপন করি, হারানো পরিবেশকে আবারও ফিরিয়ে আনি৷
প্রতিবেদন: সাগর সরওয়ার
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন