‘বুলশিট জব’ নিয়ে কিছু কথা
২০১৮ সালে প্রকাশিত মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ ডেভিড গ্রেবারের ‘বুলশিট জবস: আ থিওরি’ বইটি প্রকাশের পর থেকে বেশ আলোড়ন তৈরি করেছে৷ তাঁর মতে, পৃথিবীতে ‘বুলশিট জব’ বা অপ্রয়োজনীয় কাজে ভরে গেছে৷ চলুন তাঁর যুক্তিগুলো জেনে নিই৷
‘বুলশিট জব’ ভর্তি সমাজ
অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেয়নেসের ১৯৩০ সালের একটি তত্ত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়ে গ্রেবার বলেন, একুশ শতকে প্রযুক্তি এতটাই এগিয়ে দেবে মানুষকে সপ্তাহে ১৫ ঘন্টার বেশি কাজ করতে হবে না৷ গ্রেবার বলছেন, প্রযুক্তি ঠিকই এগিয়েছে৷ কিন্তু কাজের ঘন্টা কমেনি৷ কারণ, মানুষ অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যস্ত৷
এই লোকের কি আদৌ প্রয়োজন আছে?
কার্ট জার্মানির মিলিটারির লজিস্টিক্স বিভাগকে সহযোগিতা করেন৷ ধরুন, একজন অফিসার অফিস বদল হয়ে নীচের তলায় গেলেন৷ তিনি চাইলেই কম্পিউটার সঙ্গে করে নিতে পারবেন না৷ অফিসকে জানাবেন৷ অফিস কার্টকে খবর দেবে৷ কার্ট পাঁচশ’ মাইল দূর থেকে এসে কাগজ সই করে লজিস্টিকস বিভাগের সহযোগিতায় কম্পিউটার নীচে নামাবেন৷ লেখকের প্রশ্ন, সমাজে কার্টের অবদান কী?
কমেছে উৎপাদনের কাজ, বেড়েছে ব্যবস্থাপনার
লেখক যুক্তি দিচ্ছেন, ১৯১০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শিল্প, খামার, এমনকি বাড়ির কাজের লোকের সংখ্যা কমেছে ব্যাপকহারে৷ কিন্তু বেড়েছে ব্যবস্থাপনা, বিক্রেতা ও অফিস সংক্রান্ত চাকরির সংখ্যা, যুক্তরাষ্ট্রে যা ৭৫ ভাগ৷ ব্রিটিশ জরিপ সংস্থা ইউগভের হিসেবে, ২০১৩ সাল নাগাদ ৩৭ ভাগ ব্রিটিশ নাগরিক মনে করেন, তাদের কাজ সমাজের জন্য বিশেষ কোনো অর্থ তৈরি করে না, ডেনমার্কে এমনটা মনে করেন ৪০ ভাগ চাকুরিজীবী৷
ক্লিনার ছাড়া চলবে না, কিন্তু এইচআর?
লেখকের যুক্তি, একজন ক্লিনার যে কাজটি করেন, সে হিসেবে এতই কম বেতন পান যে হয়তো একে কেউ কেউ ‘শিট জব’ ভাবতে পারেন৷ কিন্তু ক্লিনার ছাড়া একটি প্রতিষ্ঠান, একটি এলাকা চলবে না৷ কিন্তু এইচআর বা জনশক্তি বিভাগের এই যে এত কর্মচারী, তাদের একজন না থাকলে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হবে না৷ তাই এই চাকরি নিরর্থক৷
পাঁচ ধরনের বুলশিট জব
গ্রেবার পাঁচ ধরনের কাজকে বুলশিট জব বলছেন৷ এর একটি হলো ভৃত্য বা চাকরের কাজ৷ রাজা যখন দরজা দিয়ে ঢোকেন বা বের হন, তখন দু’জন ভৃত্য দরজা খুলে দেন৷ রাজা কিন্তু দরজা নিজেই খুলতে পারেন৷ কিন্তু এই ভৃত্যরা হলো রাজা যে শ্রেষ্ঠ সেটা প্রমাণ করার জন্য৷ আজকের দিনে রিসেপশনিস্টকে এর সঙ্গে তুলনা করেছেন গ্রেবার৷ বলেছেন, সারাদিনে তাদের যতটা সময় কাজ করতে হয়, তার চেয়ে বেশি বসে থাকতে হয়৷
গুন্ডা বা মাস্তানের কাজ হলো দ্বিতীয়টি
গুন্ডা বা মাস্তানের কাজ হলো চাপ দিয়ে বা কায়দা করে কাজ আদায় করে নেয়া৷ আজকের দিনে করপোরেট আইনজীবী, লবিয়িস্ট, ও জনসংযোগ কর্মকর্তাদের কাজের সঙ্গে লেখক তুলনা করেন একে৷
কিছু কাজ প্রয়োজন, কিন্তু না থাকলেও চলে
তৃতীয় ও চতুর্থ ক্যাটাগরিকে এই দলে ফেলেছেন লেখক৷ একদলকে তিনি বলছেন, ‘ডাক টেপারস’, যারা এমন সমস্যা নিয়ে কাজ করেন যা অন্য কেউ করবেন না৷ তিনি একজনের উদাহরণ দেন, যিনি দিনে আট ঘন্টা ব্যয় করেন বয়স্কদের স্বাস্থ্যের অবস্থার রেকর্ড ফটোকপি করতে৷ এই কাজটি প্রযুক্তির সহায়তায় এমনিতেই করা যায়৷ কিন্তু কোম্পানির কর্তারা মনে করেন, তাতে খরচ বেশি হবে৷
টিক দেয়াই যাদের কাজ
লায়লা নামের এক নারীর কাজ ‘করপোরেট কমপ্লায়েন্স’ নিয়ে৷ তিনি মার্কিন কোম্পানিগুলো যাদের কাছ থেকে পণ্য আমদানি করে, তাদের দুর্নীতির ইতিহাস আছে কি না চেক করেন৷ প্রচুর শক্ত ‘জার্গন’-এ ভরা রিপোর্ট দেন৷ লায়লা লেখককে নিজেই বলেছেন, যদি রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ না থাকলে রিপোর্ট সব একই হয়৷
এই ম্যানেজারের কাজ কী?
আলফনসো নামের এক ব্যক্তি একটি অনুবাদক দলের ম্যানেজার৷ এই অনুবাদকেরা তাকে ছাড়াই ঠিকঠাক কাজ করেন৷ তার কাজ হলো অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে কাজ নেয়া এবং কাউকে দিয়ে কাজটি করানো৷ তিনি লেখককে বলেন, কাজের চাপ কম হলেও তা ওপরমহলকে উলটোটা বুঝিয়েই কেবল তিনি আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন৷
‘বুলশিট জব’ মানুষকে উদ্দেশ্যহীন করে
লেখক বলছেন, সমাজে মানুষের অবদান কী তা প্রমাণ হয় তার কাজ দিয়ে৷ কিন্তু অধিকাংশ মানুষই ভোগেন উদ্দেশ্যহীনতায়৷ কারণ নিজের কাজই তার কাছে নিরর্থক মনে হয়৷ তাদের বেশিরভাগ শুধু টাকার জন্য অপছন্দের কাজটি করেন৷ গ্রেবারের তত্ত্ব হলো, অপ্রয়োজনীয় খাতে টাকা ব্যয় না করে, রাষ্ট্র সবাইকে ন্যূনতম খাওয়া পড়ার নিশ্চয়তা দেবে৷ এতে সবার কাজও সমাজের জন্য অর্থপূর্ণ হবে৷
ডেভিড গ্রেবার
মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ ডেভিড রলফে গ্রেবারের জন্ম ১৯৬১ সালে৷ তিনি এখন লন্ডন স্কুল অফ ইকনোমিক্সে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন৷ তাঁর প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে ‘ডেবট: ফার্স্ট ৫০০০ ইয়ার্স’, ‘দ্য ইউটোপিয়া অফ রুলস’ ও ‘বুলশিট জবস: আ থিওরি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য৷ তিনি একাধিক সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও নৃতত্ত্ববিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন৷