বিশ্ববিদ্যালয়ে খেড়িয়া-শবর কন্যা, নজর সমাজ বদলে
১২ আগস্ট ২০২১পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী জনজাতি খেড়িয়া-শবরের জনসংখ্যা ১২ হাজারেরও কম। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরে মূলত তারা বাস করেন। প্রধানত জঙ্গলে বসবাসকারী এই জনগোষ্ঠী এখনো অত্যন্ত পিছিয়ে-পড়া। আধুনিকতার ছোঁয়া সেভাবে লাগেনি এই যাযাবর সমাজে। দারিদ্রও বেশ প্রবল। ফলে সরকারি পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনাতেও অনেকটা পিছিয়ে শবররা। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া দূরের কথা, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্কুলের গণ্ডি পার করাই এই সমাজে বড় ব্যাপার। সেখানেই অসাধ্যসাধন করেছেন রমণিতা।
প্রথমে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন। এখন পড়ছেন পুরুলিয়ার সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতকোত্তর স্তরে তাঁর বিষয় ইতিহাস। শুধু নিজেকে উচ্চশিক্ষিত করে তোলাই কি তরুণীর লক্ষ্য? না, এমনটা নয়। পুরুলিয়ার বরাবাজারের ফুলঝোর গ্রামে বাড়ি রমণিতার। বাবা মহাদেব শবর চাষবাস করে সংসার চালান। মা বেহুলা শবরের মুখ উজ্জ্বল করেছেন তার বড় মেয়ে রমণিতা। তারা তিন বোন ও এক ভাই। ছোট বোনটি পড়াশোনা করলেও বাকি দুজন ছেড়ে দিয়েছে। এই সমাজের মানুষরা নিজেদের মুলস্রোত থেকে দূরে রাখতে চান। তাই অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে তেমন উৎসাহী নন। এখানেই আলাদা রমণিতার পরিবার।
শবর কন্যা এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পড়াশোনা করেছেন। ইতিহাসে অনার্স নিয়ে পড়েছেন ঝাড়খণ্ডের পটমদা ডিগ্রি কলেজে। অনগ্রসর এই সমাজের মহিলা হিসেবে প্রথম স্নাতক হয়েছিলেন চুনি কোটাল। ফলের নিরিখে আরো উজ্জ্বল রমণিতা, স্নাতক স্তরে পেয়েছেন ফার্স্ট ক্লাস। এখন অনলাইনে ক্লাস চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই অবসরে স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। তাতে কিছু হাতখরচ উঠে আসে। বিনা পারিশ্রমিকে দু-তিনজন পড়ুয়াকে পড়ান তিনি। তরুণী সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ শবর-খেড়িয়া কল্যাণ সমিতির সংযোজক প্রশান্ত রক্ষিত বলেন, "ওকে আমরা ফেলোশিপ দিয়েছি। এক শবর মেয়ে যদি সবার কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে চান, তার উপযোগিতা আছে। আর পাঁচজন মেয়েও অনুপ্রেরণায় এগিয়ে আসবে।”
রমণিতার দুই চোখে স্বপ্ন। শিক্ষার সঙ্গে সমাজও তার নজরে। রুখে দাঁড়ান বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি কলেজে শিক্ষকতা করতে চাই। ইচ্ছে রয়েছে শবর জাতি নিয়ে গবেষণা করার। সেই লক্ষ্যে এগোতে চাই।" এর থেকেও বড় লক্ষ্য রয়েছে তার। রমণিতা বলেন, "আমি চাই সব শবর ছেলেমেয়ে স্কুলে যাক। পড়াশোনা করুক। লেখাপড়ার গুরুত্ব বোঝাতে হবে তাদের বাবা-মাকে। আমি তাই গ্রামে গ্রামে যাই। ছেলেমেয়েদের স্কুলেপাঠাতে বলি। ওদের সঙ্গে বইখাতা নিয়ে বসে পড়ি।"
প্রয়াত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী এই জনজাতির উন্নয়নে উদ্যোগী ছিলেন। তাকে বলা হত "শবর জননী"। তার ভাবনাই যেন পাথেয় রমণিতার। তাই নিজে ক্রমশ শিখরের দিকে গেলেও ভুলছেন না শিকড়কে। ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছেন প্রশাসনের। গত বিধানসভা ভোটের প্রচারে রমণিতা জেলার ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর' হয়েছিলেন। কেমন ছিল সে অভিজ্ঞতা? রমণিতা বলেন, "আমাদের শবরদের অনেকের ভোটার কার্ড থাকলেও তারা ভোট দেন না। আধার কার্ড বা ভোটার কার্ড নিয়ে ধারণা নেই। আমি তাদের ভোট দেওয়ার অধিকার নিয়ে বুঝিয়েছি। কিছু পাওয়ার জন্য ভোট দেওয়া নয়, নিজের অধিকার প্রয়োগ করার জন্য ভোট দিতে হয়।”
শবর সমাজের অনেকটাই শিক্ষা বা সমাজ সংস্কারের নিরিখে পিছিয়ে। সেই আলো এনে দিলেই কি রমণিতার লড়াই শেষ? তা নয়। শিক্ষার অভাবে সমাজে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। এর অন্যতম মাদকাসক্তি। শবর পুরুষদের একটা বড় অংশ মাদকের শিকার। এর ফলে এই জনজাতির শক্তি, উদ্যম ক্ষয় হয়েছে। এটা খুবই ভাবাই রমণিতাকে। নিজের ভাইও এই পথে হেঁটেছে। রমণিতা বলেন, "দিনের পর দিন দেখেছি, সকাল থেকেই নেশা করতে বসে যায় শবর পুরুষেরা। আমার ভাই ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছে। তারপর আর পড়েনি। যা রোজগার করে, সবটাই নেশার পেছনে উড়িয়ে দেয়।” মদ খাওয়ার প্রলোভনে পা দিয়ে শবররা জমি বন্ধক রেখে নিঃস্ব হয়েছে। সমাজ মাদকাসক্তির সমস্যা থেকে বেরোবে কী করে, জানা নেই তরুণীর।প্রশান্ত রক্ষিত বলেন, "রমণিতা এসবের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদের মুখ। ওকে দেখে অনেক মেয়েরাই পড়তে এগিয়ে আসছে। সমাজ বদলের লক্ষ্যেও এগিয়ে আসবে।”