1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিলু্প্তির পথে বিশ্বখ্যাত মাটির পুতুল

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১০ অক্টোবর ২০১৯

কৃষ্ণনগরের জগদ্বিখ্যাত মাটির পুতুল গভীর সঙ্কটে৷ ছোট আকারের মানব মূর্তি তৈরির ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন এখানকার শিল্পীরা৷ এই পুতুলের চাহিদা থাকলেও পর্যাপ্ত দাম মিলছে না৷

https://p.dw.com/p/3R3ZL
Indien Töpfermarkt in Krishnanagar
ছবি: DW/S. Payel

একতারা হাতে একজন বাউল৷ দেখলে মনে হবে, তিনি এখনই গান গেয়ে উঠবেন৷ সব্জি সাজিয়ে বসা বাজারের বিক্রেতা হাতের দাঁড়িপাল্লায় আনাজ ওজন করছেন কিংবা জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে ফেরা আদিবাসী নারী, এমন নানা মানুষের ছোট আকৃতির মাটির পুতুল তৈরির জন্য রয়েছে নদিয়ার কৃষ্ণনগরের খ্যাতি৷ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এই জেলার মৃৎশিল্পীরা বিশ্বজুড়ে সমাদর পেয়েছেন৷ আন্তর্জাতিক স্তরে পুরস্কৃত হয়েছেন৷ ৬, ৯ কিংবা ১২ ইঞ্চি উচ্চতার ‘রিয়েলিস্টিক হিউম্যান ফিগার' দেখলেই বোঝা যায়, কেন তাঁদের এত কদর৷

মাটির তাল থেকে মানুষের প্রতিকৃতি তৈরি করা হয় তাতে রং করে লাগানো হয় চুল, পরানো হয় অলঙ্কার৷ কোনো পুতুলের কোমরে বাঁধা হয় গামছা৷ কোনোটির মাথায় টুপি৷ মুখের রেখা, হাতের আঙুল, পায়ের পেশিও স্পষ্ট চিহ্নিত করা যায়৷ প্রতিটি পুতুলের চোখ দেখতে মনে হবে জীবন্ত৷ ছোট আকৃতিতে নিখুঁতভাবে মূর্তি তৈরিতে সর্বাধিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়, সময়ও লাগে অনেক৷

সুবীর পাল

কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পে বদল এসেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে৷ বাণিজ্যিক কারণে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য৷ এখন এই শহরের ঘূর্ণির পুতুলপট্টির শিল্পীরা মাটির বদলে অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে মূর্তি তৈরি করছেন, সেটাও আবার বড় আকারের৷ ফাইবার গ্লাস, প্লাস্টার অফ প্যারিসের ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপকভাবে৷ ১২ ইঞ্চির পুতুলের বদলে চার ফুটের একটি মানব প্রতিকৃতি তৈরি করলে অনেক বেশি দামও পাওয়া যাচ্ছে৷

কৃষ্ণনগরের প্রথম সারির মৃৎশিল্পী সুবীর পাল বলেন, ‘‘ছোট প্রতিকৃতি তৈরি করলে ভালো মজুরি পাওয়া যাচ্ছে না৷ একটা ছয় ইঞ্চির ফিগার তৈরি করতে দুদিন সময় লাগে৷ সেটা বিক্রি করে ২০০-৫০০ টাকা পাওয়া যায়, সেটা দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে৷ ক্রেতারা অনেক সময় এই দাম দিতে চান না৷ কিন্তু, ছয় ফুটের একটি ফাইবার গ্লাসের ফিগার স্বচ্ছন্দে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে যায়৷ বাণিজ্যিক কারণেই বড় মূর্তির দিকে শিল্পীরা ঝুঁকছেন৷''

পুতুলপট্টির আরেক শিল্পী সঞ্জয় সরকার একই সুরে বলেন, ‘‘ফিগার তৈরি করে যে রোজগার হয়, তাতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যায় না৷ ওটাই আঁকড়ে থাকলে অর্থাভাব মেটানো যেত না৷ তাই অন্য দিকে ঝুঁকতে হয়েছে৷'' ছোট পুতুল তৈরির জন্য পরিশ্রমও অনেকটা বেশি৷ সঞ্জয়ের বক্তব্য, ‘‘একটানা বসে কাজ করতে হয়, নড়াচড়া করা যায় না৷ সূক্ষ্ম কাজ বলে চোখের উপর খুবই চাপ পড়ে৷ দৃষ্টিশক্তি আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে যায়৷ এক দিকে রোজগার কম, অন্য দিকে শরীরের ক্ষতি তাই নতুন কেউ এই কাজে আগ্রহী নয়৷''

সঞ্জয় সরকার

সুবীর পালের স্টুডিয়োতে সারা বছর মোট যত মূর্তি তৈরি হয়, ছোট পুতুল তার মাত্র ১০ শতাংশ৷ মৃৎশিল্পে নতুন যাঁরা যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের ছোট পুতুলে আগ্রহ না থাকা সঙ্কট বাড়িয়ে তুলছে৷ যে কাজে বেশি টাকা, সেই কাজে আগ্রহী হচ্ছে এই প্রজন্ম৷ সুবীর বলেন, ‘‘ছোট ফিগারের কাজ শিখতে ১০-১৫ বছর সময় লাগে৷ কেউ এতটা সময় দিতে রাজি নয়৷ নতুন ছেলেরা কাজে ঢুকে রোজগার করতে চায়৷ তাই তারা ছোট পুতুল তৈরিতে আগ্রহী নয়৷ আমাদের পর আর কেউ থাকবে না যারা নিজে হাতে এই কাজটা করতে পারবে৷''

অনিবার্য এই সঙ্কট থেকে মুক্তির পথ কি নেই? সুবীরের বক্তব্য, ‘‘কর্মসংস্থানের জন্য যারা আসছে, তারা বড় মূ্র্তির দিকেই ঝুঁকবে৷ ছোট পুতুলের কাজ তারা শিখতে চাইলে, শেখাবেই বা কে? আমার স্টুডিয়োয় কাউকে শেখালে আমাকেই পারিশ্রমিক দিতে হবে৷ তাই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে৷ একটি প্রতিষ্ঠান দরকার, যেখানে মিনিয়েচার হিউম্যান ফিগার তৈরি শেখানো হবে৷ তবেই এই ঐতিহ্য বেঁচে থাকবে৷''