বার্লিনের রাইশটাগ ভবন
অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর কারণে বার্লিনের রাইশটাগ ভবনের খ্যাতি গোটা বিশ্বজুড়ে৷ নাৎসি যুগের অগ্নিকাণ্ড কিংবা দুই জার্মানির একত্রীকরণ, এই ভবন দেশটির আলোকিত আর অন্ধকার অনেক ইতিহাসেরই সাক্ষী৷
রাইশটাগের চত্বর
অবসর সময় কাটানো, প্রতিবাদ কিংবা প্রতীকী ভাষার ব্যবহারের জন্য রাইশটাগের খোলা চত্বর নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের একটি প্রিয় জায়গা৷ বার্লিনের প্রাণকেন্দ্রে এই ভবনের অবস্থান৷ ১৯৯৯ সাল থেকে জার্মান সংসদের নিম্নকক্ষ বুন্ডেসটাগের অধিবেশন বসে এখানে৷
কাচের গম্বুজ
বিখ্যাত স্থাপত্যবিদ স্যার নরমান ফস্টারের তৈরি রাইশটাগের গম্বুজ পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য৷ এর উচ্চতা ৪০ মিটার বা ১৩০ ফুট৷ যখন সংসদের অধিবেশন চলে তখন জনগণ প্রতীকী অর্থে ঐ গম্বুজ দিয়ে নীচে সংসদ সদস্যদের উপর নজর রাখতে পারেন৷
দৃষ্টিনন্দন সংসদ ভবন
স্প্রে নদীর তীরে এই ভবন গড়ে উঠে ১৮৯৪ সালে৷ স্থাপত্যশিল্পী পাউল ভালট জার্মানির প্রথম এই সংসদ ভবনের নকশা করেন৷ সে সময় কিন্তু জার্মানি রাজতন্ত্রের অধীনে ছিল৷ রাজা শাসন করতেন আর তার অধীনস্থরা সংসদে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কে অংশ নিতেন৷
ব্যালকনি থেকে গণতন্ত্রের উত্থান
মূল ভবনের বাম পাশের দ্বিতীয় জানালার ব্যালকনি থেকেই জার্মান গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়৷ রাজতন্ত্রের অবসানের পর ১৯১৮ সালের ৯ নভেম্বর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতা ফিলিপ শাইডেমান এখান থেকেই প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা দেন৷
রাইশটাগে অগ্নিকাণ্ড
১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারির ২৭-২৮ তারিখে রাইশটাগ ভবন আগুনে পুড়ে যায়৷ আডলফ হিটলার এই ভবনে আগুন দেয়ার ব্যবস্থা করে নাৎসি একনায়কতন্ত্রের সন্ত্রাস ও সহিংস অধ্যায়ের সূচনা করেন৷ এরপর রাইশটাগ ভবন পরিত্যাক্ত ছিল৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে কিছু অংশ একটি দাতব্য হাসপাতালের মাতৃত্বকালীন ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷
হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিসৌধ
রাইশটাগের মূল ভবন থেকে কিছুটা দূরে কালো লোহার তৈরি এই কাঠামো হত্যার শিকার ইহুদিদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত৷ ডিটার আপ্পেলটের তৈরি এই ভাস্কর্যে ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে হত্যার শিকার সংসদ সদস্যদের নাম ও মৃত্যুর তারিখ খোদাই রয়েছে৷
রুশদের আঁকা গ্রাফিতি
রাইশটাগ কেবল নাৎসি উত্থান নয়, পতনেরও প্রতীক৷ ১৯৪৫ সালের ২ মে রাইশটাগ দখলে নেয়া সোভিয়েত সৈনিকদের স্বাক্ষর আর বার্তা এখনও অক্ষত রয়েছে ভবনটির দেয়ালে৷ বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে তারা রাইশটাগের ছাদে লাল পতাকা উত্তোলন করে৷ যার মধ্য দিয়ে বার্লিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হয়৷
‘বিশ্ববাসী এই শহরের দিকে তাকাও’
রাইশটাগ ভবনের ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে বার্লিনের মেয়র এয়ার্নস্ট রয়টার তাঁর এই ভাষণ দেন৷ ১৯৪৮ সালে রয়টার পশ্চিম জার্মানিকে সোভিয়েতদের হাতে ছেড়ে না দেয়ার আহ্বান জানান৷ এ বিষয়ে তিনি মিত্র শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন আর ফ্রান্সকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম হন৷
বার্লিন দেয়ালের ছায়া
১৯৬১ সালে বার্লিন দেয়াল তোলার পর রাইশটাগের অবস্থান দাঁড়ায় পশ্চিম জার্মানির সীমানা ঘেঁষে৷ দক্ষিণে স্প্রে নদীর তীরে ছিল পূর্ব বার্লিনের সীমানা৷ নদী পার হয়ে মানুষ পশ্চিম থেকে পালিয়ে আসার চেষ্টা করত৷ ১৯৭০ এর দশকে নদী পাড়ি দিতে গিয়ে যারা মারা যান তাদের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় রাইশটাগের পাশের এসব ক্রস চিহ্ন৷
বার্লিন প্রাচীরের পতন ও পুনর্মিলনী
১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর বার্লিন দেয়াল খুলে দেয়ার পর সংসদ ভবনটি আবারও বার্লিনে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে৷ কয়েক মাস পর রাইশটাগ ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকা দেয়ালটি ভেঙে ফেলা হয়৷ ১৯৯০ সালের অক্টোবরের ২ থেকে ৩ তারিখ লাখো মানুষ রাইশটাগ ভবনটির সামনে দাঁড়িয়ে জার্মান পুনর্মিলনীর সেই কাঙ্খিত মুহূর্তটি উদযাপন করেন৷
মোড়কিত রাইশটাগ
১৯৯৫ সালের গ্রীষ্মে নব্বইজন আরোহী ১ লাখ বর্গমিটার রুপালী তেরপলে রাইশটাগকে ঢেকে দেয়৷ যা প্রত্যক্ষ করে ৫০ লাখ দর্শনার্থী৷ এটি ছিল ক্রিস্টো এবং জ্যা ক্লদ দম্পতি দর্শনীয় এক শিল্পকর্ম৷ এর পর থেকে রাইশটাগ সব অসম্ভবকেই সম্ভব করার এক নাম৷ গণতান্ত্রিক জার্মানির সংসদীয় কক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হওয়াটাও সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে৷
ভবিষ্যত নির্ধারণস্থল
চার বছরের দীর্ঘ সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্থাপত্যবিদ নরমান ফস্টার রাইসটাগ ভবনকে শুধু আধুনিক অভ্যন্তরীণ সজ্জাই নয় দৃষ্টিনন্দন একটি গম্বুজও উপহার দেন৷ ১৯৯৯ সাল থেকে এটি জার্মান সংসদীয় কক্ষের আনুষ্ঠানিক মর্যাদা পেয়ে আসছে৷ উপরের গ্যালারিতে হাজারো দর্শকের উপস্থিতিতে এখানেই সংসদ সদস্যরা জার্মানির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন৷