1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশ দেয় আম, পাকিস্তান দেয় পাকিস্তানি ‘কালচার'

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৫ জুলাই ২০২২

কয়েক দিন আগেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে আম পাঠিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ সেই আম শেষ না হতেই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করলো পাকিস্তান৷

https://p.dw.com/p/4EbsX
ঢাকায় পাকিস্তানের দূতাবাস
ঢাকায় পাকিস্তানের দূতাবাসছবি: bdnews24.com

এর আগেও বাংলাদেশের জন্য অবমননাকর অনেক ঘটনাই ঘটিয়েছে একাত্তরে গণহত্যা ও ধর্ষণ, লুটপাটের জন্য এখনো ক্ষমা না চাওয়া পাকিস্তান৷
গত ৩ জুলাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফকে একটন আম্রপলি” আম উপহার হিসেবে পাঠান৷ওই আমের খুশবু বাতাসে মিলানোর আগেই বাংলাদেশে পাকিস্তান হাইকমিশন তাদের ফেসবুক পেজে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বিকৃত করল৷ তারা তাদের ফেসবুকের কাভার পেজে গ্রাফিক্স-এর মাধ্যমে পাকিস্তানের পতাকার সাথে বাংলাদেশের পতাকা এক করে আপলোড করে গত বৃহস্পতিবার৷ তবে প্রতিবাদের মুখে পরে ওই পতাকা ফেসবুক থেকে রবিবার সরিয়ে নেয়া হয়৷

ঘটনা সম্পর্কে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন,"আমরা তাদের (পাকিস্তান) বলেছি, এটা আমাদের পছন্দ নয়৷ তবে তারা জানিয়েছেন, তারা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই ছবি প্রকাশ করেনি৷” পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া এই কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ এর আগে শনিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তান দূতাবাসকে পতাকা সরিয়ে ফেলতে বলে৷

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ পাকিস্তানের প্রতি নমনীয় আচরণ করছে, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ তারা মনে করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের এত ঘনিষ্ঠতার দরকার নেই৷ কারণ, পাকিস্তান এখনো চায় বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে একীভূত হোক৷

এর আগের বছর ২০২১ সালের জুলাই মাসে ইমরান খান যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এক হাজার কেজি ‘হাঁড়িভাঙা' আম পাঠিয়েছিলেন৷ এটাকে দেখা হয়েছে ‘‘ম্যাঙ্গো ডিপ্লোম্যাসি'' হিসেবে৷'' তবেপাকিস্তান বাংলাদেশের ব্যাপারে কখনোই ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নিবলে মনে করেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির৷ তিনি বলেন,  পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি৷ তারা তাদের পরাজয়কে মেনে নেয়নি৷ তাই তারা যখনই সুযোগ পেয়েছে, তখনই বাংলাদেশকে অপমান করার চেষ্টা করেছে৷

আর সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন বলেন, পাকিস্তান একাত্তরের গণহত্যার বিচার না চেয়ে তার ধারাবাহিকতাই রক্ষা করছে৷

পাকিস্তানের আমলনামা

২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম পাকিস্তানকে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে বলেন৷ তার সঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী দেখা করতে গেলে তিনি এই আহ্বান জানান৷ কিন্তু জানানো হয়, পাকিস্তান ক্ষমা চাইবে না৷ ২০০৯ সালে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি পাকিস্তানি দূত আলী বাসারকে একই আহ্বান জানান৷ কিন্তু তখনও জানানো হয় পাকিস্তান ক্ষমা চাইবে না৷

ঢাকার মাঠে পাকিস্তানি পতাকা: ২০২১ সালের নভেম্বরে ঢাকার মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে মাঠে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় পাকিস্তানি খোলোয়াড়রা পাকিস্তানের পতাকা ওড়ায় পতাকাবিধি লঙ্ঘন করে৷ ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে তারা ক্ষান্ত দেয়৷

চীন-পাকিস্তান, নাকি ভারত?

মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে  অবমাননা: ২০২১ সালের অক্টোবরে ঢাকায় পাকিস্তান দূতবাসের ওয়েব সাইটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়৷ ৯ অক্টোবর পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় প্রতিবাদ জানালে ভিডিওটি সরিয়ে ফেলা হয়৷ ২০১৯ সালে পাকিস্তানের একটি অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করা হয়৷

কূটনীতিক বহিষ্কার: ২০০০ সালে পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার ইরফান-উর রাজাকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এক সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে চরম অবমাননাকর মন্তব্য করার কারণে৷

যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে পাকিস্তান: আন্তর্জাতিক  অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যখনই জামায়াতের কোনো নেতা একাত্তরের অপরাধের জন্যদণ্ডিত হয়েছেন, তখনই পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে জামায়াত, মুসলিম লীগ ও ইমরান খানের দল তেহরিক-ই ইনসাফ, তার প্রতিবাদ করেছে৷ জামায়াত নেতাদের ফাঁসির নিন্দা জানিয়ে পকিস্তানের জাতীয় পরিষদে প্রস্তাবও পাস হয়েছে৷

জঙ্গিদের মদতদাতা পাক কূটনীতিক: ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় পাকিস্তানি দূতাবাসের কনস্যুলার কর্মকর্তা মাজহার খানকে বহিস্কার করা হয়৷ তিনি জঙ্গিদের কাছে জাল টাকা হস্তান্তর করার সময় গুলশানের এক হোটেলে গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েন৷

বহিষ্কৃত আরেক ‘জঙ্গিবান্ধবকূটনীতিক: ২০১৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ঢাকা থেকে বহিস্কার করা হয় আরেক পাকিস্তানি কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে৷ ওই ঘটনার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানও বাংলাদেশের এক নারী কূটনীতিককে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করেছিল৷

বিশ্লেষকরা যা বলেন
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘‘পাকিস্তানের সাথে তো আমাদের এত প্রেম-প্রীতির দরকার নেই৷ প্রথম বার যখন প্রধানমন্ত্রী আম পাঠিয়েছেন তখনো আমরা প্রতিবাদ করেছি৷ কিন্তু আমরা দেখছি পাকিস্তানের প্রতি বাংলাদেশের নমনীয় আচরণ৷ বাংলাদেশের ৩০ লাখ শহিদের প্রতি যদি কারুর দায়বদ্ধতা থাকে, তাহলে পাকিস্তানের প্রতি এ ধরনের নমনীয় আচরণ উচিত না৷”

‘‘পাকিস্তানের সাথে তো আমাদের এত প্রেম প্রীতির দরকার নাই’’


তার কথা, ‘‘ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের নৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে৷ তারা এটা মেনে নিতে পারেনি৷ তাই যখনই তারা পেরেছে তখনই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে৷ তাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলে তো আমরা আমাদের পাওনা আদায় করতে পারবো না৷ তাই আমাদের পাস্তিানের সাথে সর্বনিম্ন কূটনৈতিক সম্পর্কের বেশি কোনো সম্পর্ক রাখার দরকার নেই৷  তিনি বলেন, ‘‘এবার পতাকা বিকৃতির পরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে সাধারণ নমনীয় ভাষা ব্যবহার করেছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়৷

‘‘বাংলাদেশের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল’’

আর সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানে যে সরকার ছিল, তাদের উচিত ছিল বাংলাদেশে তারা যে গণহত্যা করেছে, অপরাধ করেছে তার জন্য ক্ষমা চাওয়া৷ কিন্তু তারা সেটা করেনি৷ তার পরের সরকারগুলোও একই অবস্থানে থেকেছে৷ হয়ত রাজনৈতিক কারণে, অথবা তাদের মনোভাবই এটা৷ ফলে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো হয়নি৷ ক্ষমা চাইলে সম্পর্ক ভালো হতে পারতো৷ আর ওই মনোভাবের কারণেই তারা এখনো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানাভাবে তৎপর৷ তা না হলে বাংলাদেশে বাংলাদেশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে তো হইচই করার কিছু নেই৷''

এরপরও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ কি নতজানু পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘না আমি সেটা মনে করি না৷ বাংলাদেশকে কি যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়ে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করতে হবে? বাস্তব অবস্থা হলো, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো নয়৷ সেটা পাকিস্তানের কারণেই৷ কিন্তু তারা যদি ক্ষমা চাইতো, ওইসব আচরণ বন্ধ করতো, তাহলে ভালো হতে পারতো৷ কারণ, এখন তো ওই বিষয় ছাড়া তাদের সাথে আমাদের স্বার্থের তেমন কোনো সংঘাত নেই৷ তাদের আচরণের কারণেই সম্পর্ক ভালো হচ্ছে না৷”
তার কথায় , ‘‘আমাদের মনে রাখতে হবে পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকরা আমাদের সাথে কোনো অন্যায় করেনি৷ করেছে একাত্তরে পাকিস্তানের সরকার৷ পরবর্তী সরকারগুলোও একই আচরণ করছে৷ হতে পারে তাদের কালচারই এরকম৷ ''