1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ একটি রাজনৈতিক বিষয়

১৫ জুলাই ২০২১

সত্যিই কি ভারত ভরে গেছে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীতে? কী বলছে নথি? বাস্তব পরিস্থিতি কী?

https://p.dw.com/p/3wVwt
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত
ছবি: Ankita Mukhopadhyay/DW

বিতর্ক ছিল। বিতর্ক থাকবেও। তবে সম্প্রতি তামিলনাড়ু পুলিশের বক্তব্য সেই বিতর্কে ঘৃতাহূতি দিয়েছে। পুলিশের বক্তব্য প্রচুর বাংলাদেশি নাগরিক ভুয়া পরিচয় নিয়ে ভারতে বসবাস করছেন এবং কাজ করছেন। করোনাকালে বিষয়টি তাদের নজরে এসেছে। তামিলনাড়ুতে ওই ধরনের ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কাজও শুরু হয়েছে।

তামিলনাড়ু পুলিশ কোনো নতুন কথা বলেনি। কয়েকমাস আগে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের সময়েও বার বার বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের বিষয়টি সামনে এসেছে। বিজেপি দাবি করেছে, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী হিন্দু বাংলাদেশিদের শরণার্থীর সম্মান দেওয়া হবে এবং মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হবে অথবা দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার অনুপ্রবেশকারীদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে, এমন অভিযোগও উঠেছে। ঠিক যেমন তৃণমূল অভিযোগ করেছে, শরণার্থীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন করে বিজেপি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করছে। প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশ থেকে জেএমবি জঙ্গি ভারতে আশ্রয় নিচ্ছেন, এই বিষয়টি নিয়েও। সম্প্রতি এমন কিছু জঙ্গিকে পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আগেও এমন জঙ্গি বা অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আসামের নবনিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতা হেমন্ত বিশ্বশর্মা ওই রাজ্যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের শাস্তি দেওয়া নিয়ে প্রতিদিন বিতর্কিত মন্তব্য করছেন। কিছুদিন আগে উত্তর প্রদেশে বাংলাদেশি চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু হয়েছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, ভারতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা কত? যারা দিনের পর দিন এ দেশে ভুয়া পরিচয় নিয়ে কাজ করে চলেছেন? কেনই বা তারা নিজের দেশ ছেড়ে এ দেশে পড়ে থাকছেন?

প্রশ্ন সহজ। উত্তর অতীব জটিল। ভারতে কোন রাজ্যে কত সংখ্যক বাংলাদেশি ভুয়া পরিচয় নিয়ে আছেন, অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা কত, তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। উদাহরণ দিয়ে বলা যাক। ২০০৪ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রীপ্রকাশ জয়সওয়াল সংসদে বলেছিলেন, এক কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করছেন। পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে তারা ভারতে ঢুকছেন। যা নিয়ে তুমুল বিতর্কের পর মন্তব্য পরিবর্তন করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। জানান, নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে এ কথা তিনি বলেননি। শোনা কথায় বিশ্বাস করেছিলেন। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গের সরকার সে সময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ওই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। প্রায় ১২ বছর পর ২০১৬ সালে বিজেপি সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু সংসদে আবার সেই কথাই বলেন- এক কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি ভারতে অবৈধভাবে আছেন। এবং এবারও তিনি কোনো তথ্যসূত্র দেননি। তথ্যসূত্র দেওয়া সম্ভবও নয়। ভারত সরকারের তথ্যের সঙ্গে রিজিজুর তথ্যের আকাশ-পাতাল ফারাক।

বিএসএফ এবং ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক হাজার ১১৫ জন বাংলাদেশিকে সীমান্তে আটক করা হয়েছে। ভারতে ঢোকার বৈধ কাগজ তাদের কাছে ছিল না। ওই একই সময়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে যেতে গিয়ে আটক হয়েছেন তিন হাজার ১৭৩ জন। ভারতে অবৈধভাবে থেকে তারা দেশে ফিরছিলেন। এই যদি সরকারি হিসেবে অবৈধ অনুপ্রবেশের বাৎসরিক সংখ্যা হয়, তাহলে কোটি কোটি অনুপ্রবেশের হিসেবটির ভিত্তি কী? কোন তথ্যের উপর নির্ভর করে এ কথা বলা যায়? কেন্দ্রীয় সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা আরো ভয়ংকর তথ্য দিয়েছেন ডয়চে ভেলেকে। ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময় ধরা পড়া অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নাম অনেক সময় নথিভুক্তই করা হয় না। সময় বাঁচাতে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ কাজে অর্থের লেনদেন হয়, এমন অভিযোগও সীমান্তে কান পাতলেই শোনা যায়।

দেশের মানবাধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন আশিস গুপ্তা। আসামে অনুপ্রবেশকারীর বিষয়টি নিয়েও বহুদিন ধরে কাজ করছে তার সংগঠন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ‘‘ভারত সরকারের হাতে যদি সত্যিই নথি থাকত, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে একাধিক আলোচনায় এ বিষয়টি তোলা হতো। কিন্তু ভারত কখনো দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এ নিয়ে কথা বলে না। এ থেকেই বোঝা যায়, বিষয়টি আসলে রাজনৈতিক। বাস্তবের সঙ্গে তার বিশেষ যোগ নেই।’’

তাহলে কি বাংলাদেশি নাগরিকেরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করছেন না? ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের অভিজ্ঞতা কিন্তু তা বলে না। তারা জানেন, সংখ্যাটি যেমন কোটি কোটি নয়, তেমন মাত্র কয়েক হাজারও নয়। সমাজকর্মী এবং সাংবাদিক মিলন দত্তের বক্তব্য, ‘‘বহু বাংলাদেশি যে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে কাজ করছেন, তা চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখা যায়। বিষয়টি রাজনৈতিক চোখ দিয়ে দেখলে জটিল মনে হবে। আর্থ-সামাজিক চোখ দিয়ে দেখলে সহজে বোঝা যাবে।’’

ফের উদাহরণ দেওয়া যাক। আলাউদ্দিনের (নাম পরিবর্তিত) বাড়ি বাংলাদেশের খুলনায়। কলকাতায় তার দুইটি মালবাহী গাড়ি আছে। আধারকার্ডও আছে। কিন্তু ভোটার কার্ড নেই আর ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স ছাড়াই দিনের পর দিন গাড়ি চালাচ্ছেন তিনি। পুলিশ ধরলে ঘুস দিয়ে দেন। আলাউদ্দিনের ছেলে ক্লাস ফোরে পড়ে। মেয়ে ক্লাস নাইনে। নাইনে পড়ার সময় ভারতে লকডাউন শুরু হয়। আলাউদ্দিনের রোজগার কমে। মেয়েকে খুলনার বাড়িতে মা-বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন আলাউদ্দিন। ছেলেকে রেখে দিয়েছেন নিজের কাছে। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, সীমান্তের দুইপারেই দালাল আছে। প্রাথমিক ভাবে সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়া এবং কাগজপত্র তৈরি করে দেওয়ার কাজ তারাই করে অর্থের বিনিময়ে। ভুয়ো কাগজপত্র বার করতে সময় লাগে না।

কিন্তু প্রয়োজন কী? বাংলাদেশ থেকে ভারতে এলে কি কাজ বেশি পাওয়া যায়? মজুরি বেশি? আলাউদ্দিনের বক্তব্য, স্কিলড লেবার হলে ঢাকায় গিয়ে কাজ করলে উপার্জন বেশি হয়। বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টরে। কিন্তু স্কিল না থাকলে ভারতে এসে কাজ করার সুবিধা বেশি। ভারত বড় দেশ বলে এখানে নানা ধরনের কাজের সুযোগ বেশি। নানা ধরনের ট্রেনিংয়ের সুযোগও বেশি। আলাউদ্দিনের বক্তব্য, কলকাতায় দুইটি গাড়ি কিনে তিনি যা উপার্জন করছেন, খুলনায় বসে তার অর্ধেকও সম্ভব ছিল না। কলকাতার রোজগারে খুলনার পরিবারও চলছে।

তরিকুল (নাম পরিবর্তিত) আবার কাজ করেন গুজরাটের সুরাটে। হিরের কারখানায় কাজ শিখে এখন উপার্জন করেন। সেখানে দৈনিক মজুরি দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। বাংলাদেশে এই অর্থ দৈনিক মজুরি হিসেবে পাওয়া যায় না। ফলে ১২ বছর আগে অবৈধ পথে ভারতে এসে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। এখন তার ভারতীয় ভোটার কার্ড, আধার কার্ড সবই আছে। তবে আরো বছর পাঁচেক কাজ করে তিনি আবার বাংলাদেশে দেশের বাড়িতে ফিরে যাবেন। ভারতে থাকবেন না। সেখানেও তার সমস্ত নথিপত্র আগের মতোই আছে।

সুজিত মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত) ১৯৯২ সালে পরিবারের সঙ্গে চলে এসেছিলেন ভারতে। ধর্মীয় কারণে তিনি ভারতে আসতে চেয়েছিলেন বলে ডয়চে ভেলেকে তরিকুল জানিয়েছেন। তিনি বা তার পরিবার আর দেশে ফিরবেন না। সুজিত জানিয়েছেন, বৈধভাবে ভারতে কাগজপত্র বানিয়ে বসবাস করছেন তারা। এখন তারা ভারতের নাগরিক। বাংলাদেশের কাগজপত্র আর নেই।

মিলন দত্তের বক্তব্য, ‘‘চাইলে এই পুরো বিষয়টির তথ্য বার করা সরকারের পক্ষে সম্ভব। কত সংখ্যক মানুষ এদেশে আছেন এবং তাদের কতজন অবৈধ ভাবে আছেন, তা বার করা খুব কঠিন কাজ নয়। কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই কোনো সরকার তা করবে না। আসল সংখ্যা সামনে এলে শাসক-বিরোধী দুইপক্ষই সমস্যায় পড়বে। রাজনৈতিক প্রয়োজনে নিজেদের মতো করে সমস্যাটিকে আর ব্যবহার করা যাবে না।’’ মিলনের বক্তব্য, আগে সীমান্তে কড়াকড়ি ছিল না। ফলে অবৈধ অনুপ্রবেশ অনেক সহজ ছিল। সকালে ভারতে ঢুকে কাজ করে বিকেলে বাংলাদেশে ফিরে গেছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে। এখন কড়াকড়ি বেড়েছে। তাই অনেকে বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে ভারতে আসছেন। এক বছরের জন্য বাংলাদেশিদের ভিসা দেয় ভারত। সেই ভিসায় টানা ৯০ দিন থাকা যায়। বৈধ ভিসা নিয়ে এপারে এসে অনেকে অবৈধ ভাবে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজে যোগ দিচ্ছেন, ইদানীং এমন ঘটনাও ঘটছে। ৯০ দিন থেকে কয়েকদিনের জন্য দেশে ফিরে আবার তারা ফিরে আসছেন ভারতে। মিলনের প্রশ্ন, ‘‘এক্ষেত্রে কী বলা হবে? অনুপ্রবেশকারী তো নয়, কারণ বৈধ কাগজ আছে। কিন্তু অবৈধ কর্মজীবী, কারণ ভিসা কাজের অধিকার দেয় না।’’

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নিয়ে কাজ করে মানবাধিকার সংগঠন মাসুম। তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কিরিটি রায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির একটি গ্রাম থেকে রাজশাহীর হাসপাতালের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। অন্যদিকে, জলঙ্গি থেকে বহরমপুরের দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। যেখানে ভালো হাসপাতাল আছে। দীর্ঘদিন ধরে জলঙ্গি অঞ্চলের মানুষ শারীরিক অসুস্থতায় রাজশাহী যান চিকিৎসা করাতে, পরিচয় গোপন রেখে। আবার কোচবিহার সীমান্তে উল্টো ঘটনা ঘটে। কিরিটির মতে, ‘‘শুধু বাংলাদেশের মানুষ ভারতে আসছেন, তা নয়। ভারতের মানুষও বাংলাদেশ যাচ্ছেন। যে যেখানে কাজের, শিক্ষার এবং চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন, তিনি সেখানেই যাওয়ার চেষ্টা করছেন।’’ বাংলাদেশে কাজ করতে গিয়ে ভারতীয় আটকে পড়েছেন, এমন তালিকাও কিরিটির কাছে আছে।

কিরিটির বক্তব্য, ‘‘নেপাল বা ভুটানের মানুষদের কি আমরা অনুপ্রবেশকারী বলি? সেক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই বা বিষয়টিকে কেন অনুপ্রবেশ হিসেবে দেখা হবে? ইউরোপের মতো বিষয়টিকে স্বাভাবিক করে দেওয়া যায়। কিন্তু এদেশের রাজনীতি তা হতে দেবে না।’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য