বস্তির ছেলেদের স্বপ্নের ব্যান্ড
কলকাতায় জঞ্জালস্তূপের ধারের বস্তিতে তাদের বাস। কেউ অনাথ, কেউ চলে যাচ্ছিল অন্ধকার জগতে। সংগীত তাদের ফিরিয়ে এনেছে মূলস্রোতে।
ঠিক যেন রূপকথা
মধ্য কলকাতার ট্যাংরা নানা কারণে বিখ্যাত। ব্রিটিশ আমল থেকে এখানে আছে অসংখ্য চামড়ার কারখানা। পাশেই ধাপার মাঠ, কলকাতার সমস্ত জঞ্জাল যেখানে জমা করা হয়। তারই পাশের বস্তিতে বেড়ে উঠেছে একদল তরুণ। বিপথে যাওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা তাদের ছিল। কিন্তু কোনো এক আশ্চর্য কারণে তারা সংগীতের সুতোয় আটকে পড়ে। তৈরি করে ট্যাংরা ব্লুজ ব্যান্ড। কলকাতায় এখন ট্যাংরা ব্লুজ একটা নাম।
প্রেসিডেন্সির শো
স্টেজের উপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যে ছাত্ররা, তাদের অনেকেই স্কুলের গণ্ডি পার করতে পারেনি। পড়াশোনার সুযোগই হয়নি। ছোট বয়স থেকে অমানবিক পরিবেশের মধ্যে কাজ করতে হয়েছে অনেককেই। তারাই এখন দাঁড়িয়ে আছে প্রেসিডেন্সি কলেজের ফেস্টে। শয়ে শয়ে ছাত্রছাত্রী শুনতে এসেছে ট্যাংরা ব্লুজের গান।
রাস্তা সহজ ছিল না
অসামাজিক কাজকর্মের জন্যও বিখ্যাত ট্যাংরার বস্তি। সেখানে এক নেপথ্য নায়কের অনুপ্রেরণায় ধীরে ধীরে গানের সুতোয় বাধা পড়ে সুজন-কারান-রাহুল-সুমিতরা। গান-বাজনার ইচ্ছে ষোলোআনা, কিন্তু যন্ত্র কেনার পয়সা কই? জঞ্জালের স্তূপ ঘেঁটে বালতি, থালা, থার্মোকলের বাক্স, পুরনো লোহার রড দিয়ে নিজেরাই নিজেদের বাজনা তৈরি করেছেন এই শিল্পীরা।
সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়
গানের পাশাপাশি পড়াশোনাও করেছেন সুরজিৎ। এখন বিকম পড়ছেন। বাবা চামড়ার কারখানায় কাজ করেন। মা বাড়ি বাড়ি ঠিকে কাজ করেন। একসময় সুরজিৎকে নেশার জিনিসপত্র বিলি করতে হতো। ট্যাংরা ব্লুজ জীবন বদলে দিয়েছে। সুরজিৎ নিজেদের তৈরি রোটো, বাঁশি এবং গিটার বাজাতে পারেন।
সুজয় হেলা
ট্যাংরা ব্লুজের মূল ড্রামবাদক। খুব ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছেন। পড়াশোনা করতে পারেননি বেশিদূর। কারখানায় কাজ জোটাতে হয়েছিল। এখন ড্রাম বাজান। গানবাজনা নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে চান।
সুরজিৎ মণ্ডল
হ্যান্ড গ্লাভসের কারখানায় কাজ করেন সুরজিতের বাবা। সুরজিৎ অবশ্য দাঁতে দাঁতে চেপে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। এখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। ট্যাংরা ব্লুজের পারকাশন তাকে ছাড়া বাজে না।
সুমিত হাজরা
ট্যাংরা ব্লুজে বাঁশি বাজান দ্বাদশ শ্রেণির সুমিত। বাবা কারখানার শ্রমিক, মা ঠিকে কাজ করেন বাড়িতে। ট্যাংরা ব্লুজ সুমিতের সামনে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। বড় হয়ে গান বাজনা নিয়েই থাকতে চান। তবে পড়াশোনাও ছাড়বেন না।
রাহুল হরি
ট্যাংরা ব্লুজের একেবারে গোড়ার সময় থেকে আছেন রাহুল হরি। কীভাবে এনজিও এসে তাদের বস্তিতে লেখাপড়ার আবহাওয়া তৈরি করেছিল। কীভাবে গান-বাজনার হাতেখড়ি। কীভাবে নিজেরা যন্ত্র বানাতে শুরু করলেন, এই সব কথা ছবির মতো বলে যেতে পারেন রাহুল। দৃষ্টি ছলছলে হয়ে যায়। রাহুলের ড্রাম মঞ্চে কথা বলে।
কারান হরি
সপ্তম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা হয়নি কারানের। অভাবের সংসারে তাকেও কাজে লেগে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই গানবাজনার আবহে বড় হয়েছেন কারান। বাবা কারখানা থেকে ফিরে ঢোল বাজাতেন। বাড়িতে একটা ছোট্ট কিবোর্ডও ছিল। ট্যাংরা ব্লুজে একেবারে শুরু থেকে আছেন কারান।
সুজন দাস
ট্যাংরা ব্লুজের অন্যতম আকর্ষণ সুজন। এগারো বছরের সুজন গান গায়। র্যাপ করতে পারে। পাশাপাশি চলছে পড়াশোনাও। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সুজন গান ছাড়বেন না, ঠিক করে ফেলেছেন।
সঞ্জয় মণ্ডল
ট্যাংরা ব্লুজের নেপথ্য নায়ক সঞ্জয়। অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা সঞ্জয়, পথ-বেপথ সবই চেনেন। মদ-জুয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে থানায় গেছেন। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন, রাজনীতির শিকারও হয়েছেন। পুলিশের হাতে হেনস্থা হতে হয়েছে বহুবার। সেই সঞ্জয়ের পরিকল্পনাতেই গড়ে উঠেছে ট্যাংরা ব্লুজ। সংগীতের সুতোয় গেঁথে ফেলেছেন সকলকে। এখন দেশ-বিদেশে তার নাম। পরিচালক সুপ্রিয় সেন ছবি বানিয়েছেন ট্যাংরা ব্লুজ নিয়ে।