বর্ণিল আয়োজনে স্বপ্নপূরণের দিন
অবশেষে বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হলো৷ প্রমত্তা পদ্মার বুকে স্বপ্নের সেতু পারাপারের সুযোগ পাচ্ছেন তারা৷ শনিবার মাওয়া প্রান্তে আনুষ্ঠানিকভাবে সেতু উদ্বোধন করে জাজিরা প্রান্তে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷
বর্ণাঢ্য আয়োজন
দীর্ঘ দুই যুগ আগে যে সেতুর পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেই সেতু উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণ উপলক্ষে পদ্মানদীর দুই প্রান্তে বর্ণাঢ্য এবং জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়৷ সেতুর জাজিরা পয়েন্টে বিশাল এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছে, যার প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷
ফলক উন্মোচন ও টোল প্রদান
পৃথিবীর অন্যতম খরস্রোতা নদী পদ্মার বুকে বহুকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী৷ শনিবার সকাল ১১টা ৫৮ মিনিটে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে ফলক উন্মোচন করেন তিনি৷ এরপর প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে নির্ধারিত টোল প্রদান করে পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে যান এবং ফলক উন্মোচন করেন৷
কড়া নিরাপত্তা
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে সেতুর মাওয়া এবং জাজিরা পয়েন্টে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী, সাদা পোশাকের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা শুক্রবারই পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেন৷
‘স্মোকপাস’ প্রদর্শনী
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী নান্দনিক ‘স্মোকপাস’ প্রদর্শনীর আয়োজন করে৷ ৩১টি বিমানের সমন্বয়ে এই মনোজ্ঞ ফ্লাইপাস্টের আয়োজন করা হয়৷ বিমানগুলোর সাহায্যে লাল-সবুজ রংয়ের মাধ্যমে পুরো এলাকাকে বর্ণিল করে তোলা হয়৷
যান চলাচল শুরু কাল
শনিবার উদ্বোধন হলেও সর্বসাধারণের চলাচলের জন্য সেদিনই খুলছে না সেতু৷ সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রীর পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হবে ২৬ জুন (রবিবার) সকাল ৬টা থেকে৷
সীমিত আকারে ফেরি চলাচল
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে চলাচলকারী ফেরি যুগের আনুষ্ঠানিক অবসান হচ্ছে৷ শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় শিমুলিয়া ঘাট থেকে ছাড়ে ‘কুঞ্জলতা’ আর ওপারের মাঝিরকান্দি ঘাট থেকে ছাড়ে ‘বেগম রোকেয়া’৷ তবে এই রুটে দৃশ্যত ফেরি যুগ শেষ হলেও সীমিত আকারে ফেরি চলাচল করবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা৷
সমাবেশে জনস্রোত
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুপুর পৌনে বারোটার দিকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করে জাজিরা প্রান্তের দিকে দলীয় সমাবেশে যোগ দিতে রওনা হন৷ সেখানে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ রাখেন৷ এ সমাবেশে অংশ নিতে দলীয় নেতা কর্মীদের জনস্রোতে পরিণত হয় সমাবেশস্থল৷
ভোগান্তির অবসান
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেলপথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে৷ এর ফলে এ অঞ্চলের মানুষের একদিকে দীর্ঘদিনের ভোগান্তির লাঘব হবে, অন্যদিকে অর্থনীতি হবে বেগবান৷ আশা করা হচ্ছে এ সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে এক দশমিক দুই-তিন শতাংশ হারে অবদান রাখবে’৷
সেতু এলাকা এখন পর্যটনকেন্দ্র
পদ্মা সেতুকে ঘিরে বেশ কয়েকমাস ধরেই আশেপাশের এলাকাগুলো পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে৷ আজ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে নদীর দুই প্রান্তেই ছিল উৎসুক জনতার উপচে পড়া ভিড়৷ নিরাপত্তাজনিত কারণে সেতুর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ না থাকলেও অনেকেই স্পিডবোট, ট্রলারে করে দূর থেকে সেতুর সৌন্দর্য উপভোগ করেন৷
নির্মাণ চ্যালেঞ্জ
বিশেষজ্ঞদের মতে, পদ্মা বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা এক নদী৷ যার বুকে সেতু গড়ে তোলা মোটেও সহজ কাজ ছিল না৷ কারণ পদ্মার নদীগর্ভের মাটি এতটাই পরিবর্তনশীল যে মুহূর্তের মধ্যে যে কোনো স্থান থেকে যে পরিমাণ মাটি সরে যায় তাতে ২১ তলা ভবনের সমপরিমাণ গভীরতার খাদ তৈরি হয়৷ তাই এই সেতু নির্মাণকে পৃথিবীর অন্যতম ‘প্রকৌশল বিস্ময়’ হিসেবে অভিহিত করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা৷
নিষেধাজ্ঞায় তোয়াক্কা নেই
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে ছিল উৎসাহ ও আনন্দ৷ পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা বেষ্টনি টপকে এবং তার কেটে ভিতরে প্রবেশ করছেন শত শত উৎসুক জনতা৷ তাদেরকে সামলাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়৷
পদ্মা সেতুর আদ্যোপান্ত
পদ্মা বহুমুখী সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৮.১ মিটার৷ মোট স্প্যান ৪১টি এবং পিলার ৮১টি৷ নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর৷ দ্বিতল এ সেতুর উপরে যান এবং নিচে ট্রেন চলাচল করবে৷ পানি থেকে সেতুটি ৬০ ফুট উঁচু এবং পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট৷ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী৷ এ সেতুর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯ জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ত্বরান্বিত হবে৷