বদলে যাচ্ছে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রিকশাচিত্র
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রিকশাচিত্রে একসময় জায়গা পেতো মাতৃপ্রেম, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা প্রকৃতি৷ কিন্তু এই লোকশিল্পের সোনালি দিন আর নেই৷ রিকশা পেইন্টারদের কদরও কমে গেছে৷ ছবিতে দেখুন ঢাকার এখনকার কিছু রিকশাচিত্র…
মনের মাধুরীতে বর্ণিল শিল্পশৈলী
নিত্যদিনের বাহন রিকশায় আঁকা বর্ণিল শিল্পশৈলীর চলন্ত প্রদর্শনী হতে থাকে ঢাকা শহরের অলিগলিতে৷ রিকশার চৌকোণো বোর্ড ও পেছনের দিকে টিনের পাতের ওপর নানান রঙে মনের মাধুরী মিশিয়ে বর্ণিল ঢঙে এগুলো ফুটিয়ে তোলেন রিকশা পেইন্টাররা৷ তবে চিত্রকলায় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নেই তাদের৷ বংশপরম্পরায় দেখে দেখে রিকশাচিত্র সাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা৷ তাদের হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের শিল্পকলা৷
চলচ্চিত্রের ব্যানার থেকে রিকশা পেইন্টিং
একসময় প্রচারের জন্য ঢাকাই চলচ্চিত্রের ব্যানার আঁকা হতো রঙতুলিতে৷ প্রযুক্তির যুগে রেক্সিনে গ্রাফিক্স করে যন্ত্রে ছেপে সেই কাজ চালিয়ে নেন পরিবেশকরা৷ এ কারণে যারা চলচ্চিত্রের ব্যানার আঁকতেন তারা কর্মশূন্য হয়ে পড়েছেন৷ তখন অনেকে রিকশা পেইন্টিং বেছে নেন৷ তাদের হাত ধরে রিকশাচিত্রে জায়গা পেতে থাকেন রুপালি পর্দার তারকারা৷
বৈচিত্র্যময় বিষয়বস্তু
রিকশার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে চিত্রকর্মে৷ একসময় রিকশার পেছনে মনোরম চিত্রকর্ম ছিল চোখ জুড়ানো৷ রঙতুলির ছোঁয়ায় চিত্রকররা ফুটিয়ে তুলতেন লতা-পাতা-ফুল-পাখি, ঐতিহাসিক বীরত্বগাথা, মুক্তিযুদ্ধ, চলচ্চিত্র, ধর্মীয় স্থাপনা, প্রাণী-প্রকৃতি, গ্রামবাংলার জনজীবন৷ স্বাধীনতার পর ঢাকাকে মাথায় রেখে কাল্পনিক শহরের দৃশ্য আঁকা হতো রিকশায়৷ একেকটা রিকশা যেন শহরজুড়ে বয়ে বেড়াতো একেকটি গল্প৷
ঝকঝকে সৌন্দর্যের আকর্ষণ
রিকশাকে নতুন রঙে সাজিয়ে তুললে মন ভালো হয়ে যায় চিত্রকরদের৷ তাছাড়া ঝকঝকে চকচকে রিকশায় যাত্রী বেশি ওঠে৷ নতুন রঙ করা ও সুন্দর চিত্রকর্মের রিকশা দেখলে যে কেউ উঠতে আগ্রহ দেখায়৷ ফলে আয়ও তুলনামূলকভাবে বেশি হয়৷ তিন চাকার বাহন রিকশার পেছনের টিনের পাত, দুই পাশের ফলক, খাঁজকাটা কারুকার্যময় ছাউনি, প্লাস্টিক ও কাগজ দিয়ে সাজানো পিতলের ফুলদানি- সবই সৌন্দর্যের অংশ৷
রিকশার উৎপত্তি
জাপানে দেড়শ বছর আগে রিকশার উৎপত্তি৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জ্বালানি সংকট দেখা দিলে এর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়৷ ১৯১৯ সালে তৎকালীন ভারতবর্ষে রিকশার প্রচলন শুরু হয়৷ কথিত আছে, বার্মা (মিয়ানমার) থেকে প্রথম চট্টগ্রামে আসে এটি৷ ১৯৪০ সালের পর কলকাতা থেকে রিকশা ঢাকায় আনেন বাঙালি জমিদারেরা৷ অভিজাতদের বাহন হিসেবে রিকশা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে৷ পঞ্চাশের দশকে রিকশাচিত্রের প্রচলন শুরু হয়৷
রিকশাচিত্রের আদি কারণ
রিকশা পেইন্টিংয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল যাত্রীদের কাছে বাহনটি আকর্ষণীয় করে তোলা৷ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এ অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পায় রিকশা পেইন্টিং৷ ষাট ও সত্তরের দশক ছিল রিকশাচিত্রের স্বর্ণযুগ৷ তবে ১৯৭০ সালের দিকে রিকশায় মানুষের ছবি আঁকা নিষিদ্ধ করে তখনকার পাকিস্তান সরকার৷ ধরন পাল্টাতে বাধ্য হন চিত্রকররা৷ রিকশাচিত্রে দেখা যায় বাঘ-হরিণসহ নানা ধরনের প্রাণী৷
আঁকার রঙ-ঢঙ
রিকশা আর্টের একটি নির্দিষ্ট গঠন আছে৷ সেজন্য অনায়াসে এই শিল্পকর্ম চেনা যায়৷ উজ্জ্বল এনামেল রঙে আঁকা সুস্পষ্ট, সাবলীল ও প্রাণবন্ত গঠন মানেই রিকশা আর্ট৷ এক্ষেত্রে চিত্রকররা ফ্লুরোসেন্ট নীল, সবুজ, লাল, হলুদ, গোলাপি রঙ বেশি ব্যবহার করেন যাতে দূর থেকেও স্পষ্ট বোঝা যায়৷ রঙ ব্যবহারে একেবারে স্বাধীন তারা৷
রিকশায় মাতৃভক্তি
ঢাকার অধিকাংশ রিকশায় দেশীয় সংস্কৃতির রঙে ‘মা’ শব্দটি লেখা থাকে৷ পেছনের দিকে ছাউনির দুই পাশে নয়তো টিনের পাতে ‘মা’ উল্লেখ করেন চিত্রকররা৷ কোনোটিতে চিত্রকর্মের জায়গায় সাজানো হয় ‘মায়ের দোয়া’ কথাটি৷ কোনো কোনো রিকশায় চোখে পড়ে ‘মা-বাবার দোয়া’৷ উপস্থাপনে স্বকীয়তার সুবাদে দেশ-বিদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে রিকশাচিত্র৷
চলন্ত সামাজিক বার্তা
গত ৫০ বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে রিকশা পেইন্টিং করা হয়েছে৷ কিছু কিছু রিকশার পেছনে সামাজিক বক্তব্যও চোখে পড়ে৷ একটি রিকশায় শব্দদূষণ পরিহারের আহ্বান জানাতে লেখা রয়েছে, ‘অযথা হর্ন বাজাবেন না৷’ চিত্রকর্মের মতো বিভিন্ন বার্তাও রিকশায় নিজস্ব ঢঙে আঁকেন চিত্রকররা৷
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
ইদানীং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে ঢেকে দেওয়া হয় রিকশার পেছনের অংশ৷ রিকশা পেইন্টারদের কাজে আগের মতো বৈচিত্র্যও পাওয়া যায় না৷ অল্প যে কজন রিকশা পেইন্টার টিকে আছেন, তাদের অধিকাংশই প্রায় একই পেইন্টিং বারবার কপি করেন৷ এ কারণে রিকশা মালিকদের কাছে হাতে আঁকা অপেক্ষাকৃত বেশি দামি রিকশাচিত্রের চাহিদা কমে গেছে৷ তারা কম টাকায় রেডিমেড রঙ ও ছবি দিয়ে রিকশা সাজান, নয়তো বিজ্ঞাপন সেঁটে দেন৷
চিত্রকরদের ঠিকানা
রিকশা পেইন্টিংয়ের ওপর নির্ভর করে একটি শ্রমজীবী শ্রেণির জীবিকা৷ তাদের অনেকে ছিলেন রিকশার মিস্ত্রি৷ ধীরে ধীরে নিজেরাই হয়ে উঠেছেন চিত্রকর৷ রাজধানীর বকশীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, বংশাল, নারিন্দা, দয়াগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, মোহাম্মদপুর, জিগাতলা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তানসহ আরো কয়েকটি জায়গায় রিকশা পেইন্টিং করা হয়৷ এমন চিত্রকরদের কেউ কেউ ৪০-৫০ বছর ধরে রিকশাচিত্রের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন৷
আয়-রোজগার
চিত্রকররা একেকটি রিকশার চিত্রকর্মের জন্য সাড়ে সাত হাজার টাকার মতো নেন৷ তবে রিকশার মালিক সরঞ্জামাদি কিনে দিলে চিত্রকররা সাধারণত সাড়ে তিন হাজার টাকা মজুরি পান৷ এখন মাসে সর্বোচ্চ দুই থেকে পাঁচটা কাজ আসে৷ পুরোনো রিকশা ঘষামাজা করে নতুনভাবে চিত্রকর্ম আঁকার কাজও হয়৷ পুরোনো রিকশা পেইন্টিংয়ের জন্য দুই-তিন হাজার টাকা পান তারা৷
রিকশায় ডিজিটাল ছবি
কালের পরিক্রমায় হাতে আঁকা রিকশাচিত্রের জায়গা দখল করছে ডিজিটাল প্রিন্ট৷ এখন রিকশা আর্টে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে৷ রিকশা মহাজনরা কম খরচে ডিজিটাল ছবি বেছে নেওয়ায় চিত্রকরদের কদর কমেছে৷ ডিজিটাল প্রিন্টের কারণেই মূলত হারিয়ে যেতে বসেছে নগরকেন্দ্রিক এই ঐতিহ্য৷ আগের মতো রিকশায় বাহারি নকশার পেইন্টিং খুব বেশি চোখে পড়ে না৷ রিকশার অলঙ্ককরণে ব্যবহার হয় না ঝালর৷ ইদানীং বাহন সাজানোর বিষয়টিও কমে গেছে৷
চিত্রকরদের দুর্দশা
একসময় রিকশা পেইন্টারদের অনেক কদর ছিল৷ এখন হাতেগোনা কয়েকজন রিকশা পেইন্টার কোনোরকমে টিকে আছেন৷ তবে কেউ খুব ভালো নেই৷ কারো হাতে আশানুরূপ কাজ নেই৷ পেট চালানোই এখন দায়৷ বংশপরম্পরায় এই পেশায় আসা চিত্রকররা অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন৷ সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাদের৷
মহাজনদের অবহেলা
ঢাকায় নব্বই দশক পর্যন্ত রিকশাকে বাহারি রঙে সাজানোর তোড়জোর দেখা যেতো৷ কে কত ভালো রিকশা বানাবেন তা নিয়ে মহাজনদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো৷ কিন্তু এখন কোনোমতে রিকশা রাস্তায় নামিয়ে দিলেই তারা খুশি৷ রিকশা সাজিয়ে না দিলেও চালকদের কাছ থেকে দিনের নির্দিষ্ট জমার অঙ্ক ঠিকই বুঝে নেন মহাজনেরা৷ বাজারে রিকশাচিত্রের সস্তা প্রিন্টেড কপি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় কেনা যায়৷ হাতে আঁকা চিত্রকর্মে তাই মহাজনদের বেশি আগ্রহ নেই৷
বিলুপ্তির আশঙ্কা
অনাদরে-অবহেলায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অলঙ্কার রিকশাচিত্র ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে৷ রিকশার চিত্রকরদের অনেকে বেকার হয়ে পড়ায় হুমকির মুখে পড়েছে রিকশাচিত্র৷ বেশিরভাগ চিত্রকর পেশা পরিবর্তন করেছেন৷ সব মিলিয়ে রিকশাচিত্র এখন বিলীয়মান একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে৷
চলচ্চিত্রে রিকশাচিত্র
অমিতাভ রেজা চৌধুরী পরিচালিত ‘রিকশা গার্ল’ চলচ্চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রিকশাচিত্র৷ ছবিটিতে ব্যবহৃত সমস্ত রিকশায় ছবি এঁকেছেন রিকশা পেইন্টার সোলেমান৷ সম্প্রতি বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নির্মাতা জানিয়েছেন, শিল্পকলা হিসেবে রিকশাচিত্রকে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরার প্রয়াস ছবিটি নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য৷
বিদেশের জাদুঘরে রিকশাচিত্র
রিকশাচিত্রের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন বিদেশিরাও৷ বাংলাদেশি রিকশাচিত্রের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ রয়েছে জাপানের ফুকুওকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামে৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত রিকশা পেইন্টার সৈয়দ আহমেদ হোসেনের চিত্রকর্ম৷ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বাংলাদেশের সুচিত্রিত রিকশা যত্নে রাখা আছে৷ দুই বছর আগে মার্কিন সাংবাদিক অ্যান্ডি আইজ্যাকসন ঢাকায় থেকে একটি রিকশা বানিয়ে নিয়ে গেছেন নিউইয়র্কে৷
রিকশা আর্টের বিক্রয়কেন্দ্র
রিকশা চিত্রকরদের কল্যাণে চালু হয়েছে ‘রিকশা-পেইন্ট ডট নেট’ (www.rickshaw-paint.net) নামের ওয়েবসাইট৷ এটি রিকশাচিত্রের বিক্রয়কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে৷ শিল্পীদের ভালো অঙ্কের টাকা আয় করিয়ে দেওয়াই এর উদ্দেশ্য বলে ওয়েবসাইটটির দাবি৷
বহির্বিশ্বে রিকশাচিত্রের প্রদর্শনী
১৯৮৮ সালে ‘ট্রাফিক আর্ট: রিকশা পেইন্টিং ফ্রম বাংলাদেশ’ শিরোনামের বিশেষ প্রদর্শনী হয় লন্ডনের এক জাদুঘরে৷ জাপানের ফুকুওকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামে রিকশাচিত্র নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছে৷ ২০১৩ সালে জাপানের তাকামাতসু শহরের এক উৎসবে রিকশাচিত্র গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করা হয়৷ নেপালে বাংলাদেশি রিকশাচিত্রের প্রদর্শনী হয়েছে৷ ১৯৯৯ সালে ঢাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে বাংলাদেশের রিকশা পেইন্টিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী হয়৷