ফ্রানৎস কাফকা: প্রাগ থেকে গোটা বিশ্বে
কাফকার সময় প্রাগ ছিল ইউরোপের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র৷ শহরটি ও সেখানকার মানুষ মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে কাফকার উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল৷ প্রাগেই তিনি যন্ত্রণাভোগ করেছেন, লিখেছেন এবং খ্যাতি অর্জন করেছেন৷
লেখক ফ্রানৎস কাফকা
১৮৮৩ সালের তেসরা জুলাই প্রাগে জন্মগ্রহণ করেন ফ্রানৎস কাফকা৷ লেখক তাঁর নিজস্ব সংবেদনশীল মন দিয়ে এই শহরের পুরো পরিবেশ নিজের করে নিয়েছিলেন৷ প্রাগের মানুষ, সেখানকার বই সবকিছুই কাফকার উপর প্রভাব ফেলেছিল৷
‘ডি ফেরভান্ডলুং’
একজন মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করেন যে, তিনি এক বীভৎস, বিকটাকার পোকার রূপ ধারণ করেছেন৷ এই রূপান্তরের কারণে সমাজে তার অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায়৷ তিনি চাকুরি হারান এবং তার পরিবারও তাকে অস্বীকার করেন৷ উপন্যাসে এই চরিত্রের নাম ‘গ্রেগর সামসা’৷ ‘ডি ফেরভান্ডলুং’ বা ‘রূপান্তর’ বইটির মাধ্যমে কাফকা সমাজের কাছে জটিল প্রশ্ন তুলে ধরেেছেেন
‘ডেয়ার প্রৎসেস’
একদিন ইয়োসেফ কে. আদালতে হাজির হওয়ার সমন পেলেন৷ কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর জানা ছিল না৷ ইয়োসেফ কে. শুধু এটুকু বুঝেছিলেন যে, বিচারের জটিল প্রক্রিয়ার চাকা ঘুরতে শুরু করেছে এবং তিনি সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে জড়িয়ে গেছেন৷ তিনি যা জানলেন, তা হচ্ছে রাষ্ট্র সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং মানুষ হিসেবে তিনি অত্যন্ত ক্ষুদ্র৷ ‘ডেয়ার প্রৎসেস’ বা ‘দ্য ট্রায়াল’ এর চলচ্চিত্র সংস্করণের একটি দৃশ্য এটি৷
মহানগরী প্রাগ
কাফকার সময়ে ইউরোপের একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল প্রাগ৷ এটি হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এক গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল এবং উনিশ শতকের শেষে এটি জার্মান ও চেক সাহিত্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়৷ কাফকার মতো অনেক লেখক উভয় ভাষাতেই পারদর্শী ছিলেন৷ মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তির দৃষ্টিকোণ থেকে এই শহর ও শহরের মানুষ কাফকার উপর প্রভাব ফেলেছিলেন৷
পিতা: হ্যারমান কাফকা
আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হ্যারমান কাফকা (১৮৫২-১৯৩১) পেশায় একজন মাংস বিক্রেতা ছিলেন৷ তাঁর পরিবারে তাঁর কথাই ছিল আইন৷ তরুণ বয়সে বাবাকে লেখা এক চিঠিতে কাফকা নিজেকে ‘‘পাতলা, দুর্বল ও চর্মসার’’ এবং বাবাকে ‘‘ শক্তিশালী, লম্বা, চওড়া’’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন৷ বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন কাফকা তাঁর রচনায় শক্তিধর পুরুষদের ব্যঙ্গাত্মক চরিত্রে পরিণত করে৷
বন্ধু: ফ্রানৎস ভেরফেল
ভোলটাভা নদীর তীরে গ্রীষ্মের লম্বা দুপুর কিংবা প্রাগের পাবে দীর্ঘরাত কাটাতে কাফকার সঙ্গী হতেন ফ্রানৎস ভেরফেল৷ কাফকার চেয়ে বয়সে সামান্য বড় ভেরফেল তখন সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাত ছিলেন৷ বন্ধুর সাফল্যে কাফকা ঈর্ষাবান ছিলেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি ডাব্লিউ. (ভেরফেল) কে ঘৃণা করি৷ সে স্বাস্থ্যবান, তরুণ ও সম্পদশালী আর আমি সবকিছুতেই তার থেকে আলাদা৷’’ এই মন্তব্য সত্ত্বেও অবশ্য ভেরফেল ও কাফকা বন্ধু ছিলেন৷
বাগদত্তা: ফেলিস বাওয়ার
ফেলিস বাওয়ারকে প্রথম দেখার পর কাফকা তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘‘প্রায় ভাঙ্গা নাক, খোড়োচুল, কিছুটা সোজাসাপ্টা, অনাকর্ষণীয় চুল, দৃঢ় চিবুক৷’’ এই বর্ণনা সত্ত্বেও ফেলিসের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন কাফকা এবং তাঁকে পাঁচশত চিঠি লেখেন৷ তাদের মধ্যে দু’বার বাগদান হলেও বিয়ে হয়নি৷ আর তার কারণ কাফকা৷ এক পর্যায়ে, কবির কাছ থেকে বহুদূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান বাওয়ার৷
চিকিৎসক: সিগমুন্ড ফ্রয়েড
অস্ট্রীয় স্নায়ুবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে সম্মান করতেন কাফকা৷ তাঁর একটি লেখায় সেটা প্রকাশও পায়৷ তবে ফ্রয়েড এর রোগ নিরাময়ের পন্থা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন কাফকা৷ আধুনিক মনোবিজ্ঞান ফলাফল দেখালেও কাফকার মত ছিল, ‘‘এখনো পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে আসলে কিছুই হয়নি৷’’
প্রকাশক: কুর্ট ভোল্ফ
প্রকাশক কুর্ট ভোল্ফ তাঁর সময়কার তরুণ, মেধাবীদের নিয়ে কাজ করেছিলেন৷ তবে কাফকার সঙ্গে তাঁর কঠিন সময় গেছে৷ ১৯১২ সালে কাফকার প্রথম গল্পের বই প্রকাশ করেন তিনি৷ বইটির আটশো কপি ছাপা হয়েছিল কিন্তু সেগুলো ভালো বিক্রি হয়নি৷ বই প্রকাশের কয়েক সপ্তাহ পর কাফকা লিখেছিলেন, ‘‘এগারো কপি বিক্রি হয়েছে৷ এর মধ্যে দশ কপি আমি নিজে কিনেছি৷ এগারোতম কপিটি কে কিনেছে সেটা জানতে মন চাইছে৷’’
জীবনীকার: সল ফ্রিডল্যান্ডার
ইতিহাসবিদ সল ফ্রিডল্যান্ডার নিজের জীবনের সঙ্গে কাফকার জীবনের অনেক মিল খুঁজে পান৷ এই কবির মতো ফ্রিডল্যান্ডারের বাবাও প্রাগের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন৷ আর কাফকার বোনেদের মতো এই ইতিহাসবিদের পরিবারের একাধিক সদস্যরা নাৎসি বন্দিশিবিরে প্রাণ হারান৷ কাফকার একটি প্রামাণ্য জীবনী লিখেছেন ফ্রিডল্যান্ডার৷ ১৯২৪ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়সে মারা যান ফ্রানৎস কাফকা৷