1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে উত্তাপ নেই ইউরোপে

এম আবুল কালাম আজাদ
১৬ ডিসেম্বর ২০২২

সেদিন সন্ধার পর এক সহকর্মীর সাথে রাইন নদীর পাড়ে আড্ডা জমিয়েছিলাম৷ নীরবতা ভেঙে হঠাৎ গাড়ির হর্ন শুনে দুজনেই চমকে গেলাম৷ ভাবলাম হয়ত দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ হেঁটে মূল রাস্তায় উঠতেই আমাদের ভুল ভাঙলো৷

https://p.dw.com/p/4L3Uu
 FIFA World Cup Fußball Weltmeisterschaft 2022 Logo Symbolbild
ছবি: Pavlo Gonchar/Zumapress/picture alliance

একটু আগে টাইব্রেকারে স্পেনকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে মরক্কো৷ তাই হর্ন বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছে মরোক্কানরা৷ রাস্তায় গাড়ির হর্নও ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ গাড়ির ভিতর থেকে পতাকা উঁচিয়ে অনেক চিৎকার করে জানান দেয় মরক্কো জিতেছে৷

কিছুদূর এগোতেই দেখা গেল কয়েকশ' মরোক্কান রাস্তায় জড়ো হয়েছে৷ অনেকের হাতে পতাকা৷ নেচে-গেয়ে উদযাপন করছে তারা৷ ট্রাফিক নিয়মের বালাই না করে রাস্তা দখল করে তারা উৎসবে মেতে ওঠে৷ অল্প সময়ের মাঝে মনে হলো আফ্রিকান দেশটি থেকে আসা সকল নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে এসেছে৷ হাড় কাঁপানো শীতে মাঝরাত পর্যন্ত ঐতিহাসিক জয় উদযাপন করে তারা৷

ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর হচ্ছে তা এর আগে এই শহরে টেরই পাওয়া যায়নি৷ বিশ্বকাপে ইউরোপ মহাদেশ থেকে বেশি দেশ খেলে৷ জার্মানিসহ এবার খেলেছে ১৩টি দেশ৷ ২০১০ থেকে পরপর তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছে যথাক্রমে স্পেন, জার্মানি এবং ফ্রান্স৷ এছাড়াও রয়েছে পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডের মতো ভালো দল৷

অথচ এই শহরে যেন কেউ খেলা দেখছে না৷ দু-একটি বাদে রেস্তোরাঁ বা পাব কোথাও টেলিভিশনে খেলা নেই৷ রাস্তায় নেই বড় ডিজিটাল মনিটর৷ নেই কোনো উম্মাদনা বা মাতামাতি৷ ভেবেছিলাম জার্মানির ম্যাচের দিনে হয়ত বোঝা যাবে৷ কিন্তু না, সেসব দিনেও বন শহর ছিল নীরব৷ যদিও জার্মানি প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নেয়

এই চিত্র যে শুধু বন শহরের তা নয়, বরং ইউরোপের অন্যসব শহরের দৃশ্যপটও এরকমই৷ তাহলে কি ফুটবল-পাগল ইওরোপিয়ানরা এবার বিশ্বকাপ দেখছে না?

ফুটবল মানেই উৎসব৷ বিশ্বকাপের সময় বড় বড় শহর যেন থেমে যায়৷ সবাই ব্যস্ত থাকে টিভি অথবা বড় ডিজিটাল মনিটরে খেলা দেখতে৷ বার্লিন বা বার্সেলোনার মতো শহরে চেহারাই পাল্টে যায় বিশ্বকাপের সময়৷ ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের সময়েও এই চিত্র দেখা যায়৷ কিন্তু এবার কোনো উৎসব হচ্ছে না৷

খেলার সময় পাব ও বারে থাকতো মানুষের ভিড়৷ বিয়ারের গ্লাস হাতে চিৎকার করে অনেকে উল্লাস করে খেলা উপভোগ করতো৷ এছাড়াও খেলা দেখার জন্য খোলা জায়গায় বসানো হতো বড় বড় ডিজিটাল স্ক্রিন৷ এবার সেই চিত্রটিও অনুপস্থিত৷

বেশ কিছু কারণে এবার খেলা নিয়ে উদাসীনতা তৈরি হয়েছে ইউরোপিয়ানদের মাঝে৷ আগের আসরগুলো গরমকালে আয়োজন করা হলেও এবারের বিশ্বকাপ হচ্ছে শীতকালে৷ শীতের মধ্যে পাব বা খোলা স্থানে খেলা দেখা কঠিন৷ তাই হয়ত অনেকে ঘরে বসে খেলা দেখতে পারেন৷

তবে খেলা না দেখা বা এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে অনাগ্রহের পেছনে বড় দুটি কারণ৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে বসেছে বিশ্বকাপ ফুটবলের ২২তম আসর৷ বিশ্বকাপ শুরুর আগেই মানবাধিকার প্রশ্নে কাতারের সমালোচনা শুরু হয় ইউরোপের অনেক দেশে৷ আয়োজনের প্রস্তুতিতে কয়েক হাজার শ্রমিকের মৃত্যু, মৃত্যুর তদন্ত না হওয়া, তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপার সামনে চলে আসে৷

এরপর শুরু হয় ওয়ান লাভ আর্মব্যান্ড বিতর্ক, যার মাধ্যমে ইউরোপে সকল প্রকার জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, বয়স, বিশ্বাস, সংস্কৃতি আর যৌনতার ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরোধিতা করা হয়৷ ইউরোপের সাতটি দেশ ইংল্যান্ড, ওয়েলস, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও ডেনমার্কের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেনরা এবারের কাতার বিশ্বকাপে বাহুতে ওয়ান লাভ ব্যান্ড পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷ কিন্তু ফিফার হুঁশিয়ারির পর ওই ব্যান্ড পড়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে দেশগুলো৷

এম আবুল কালাম আজাদ, ডয়চে ভেলে
এম আবুল কালাম আজাদ, ডয়চে ভেলেছবি: Private

জার্মানি-জাপান ম্যাচে খেলার শুরুর আগে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে প্রতিবাদ জানায় জার্মানির খেলোয়াড়রা৷ মাঠের বাইরে প্রাক্তন এক ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রী, জার্মান ফেডারেল মিনিস্টার, বিবিসির স্পোর্টস প্রেজেন্টার এবং ইংল্যান্ডের সাবেক নারী খেলোয়াড় অ্যালেক্স স্কটকে রেইনবো আর্মব্যান্ড পরতে দেখা যায়৷ ড্যানিশ এক টিভি রিপোর্টার ওয়ান লাভ আর্মব্যান্ড পরেছিলেন, পরে কাতারি এক কর্মকর্তা তাকে সেটি খুলে ফেলতে বলেন৷

এসবের বিরূপ প্রভাব পড়ে ইউরোপিয়ানদের মাঝে৷ এছাড়াও খেলার দুই দিন আগে মাঠে অ্যালকোহল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তও তিক্ত পরিস্থিতির জন্ম দেয়৷ এসবের প্রতিবাদ জানিয়ে জার্মান ফুটবলার ফিলিপ লাম কাতারে বিশ্বকাপ দেখতে যাননি৷ অধিকাংশ পাব ও বার জানিয়ে দেয় এবার তারা খেলা দেখার আয়োজন করছে না৷

তরুণদের মধ্যেও এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে আগ্রহ অনেক কম৷ তারাও হয়ত নীরবে প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছে৷ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও ছাত্রদের আলোচনাতেও চলে আসে কাতারের বিষয়গুলো৷ ফলে অনেকে খেলা দেখার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে৷ সব মিলিয়ে এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল আসর শেষ হচ্ছে, কিন্তু তার আঁচ ইউরোপে পাওয়া গেল না৷

তবে মরক্কো কোয়ার্টার ফাইনালে জিতে সেমি ফাইনালে উঠলে বন শহরের বাসিন্দারা আরেকটি উদযাপন দেখে৷ শুধু বন নয়, ইউরোপের অনেক শহরেই তারা রাস্তায় বেরিয়ে জয়ের আনন্দে উৎসব করেছে৷