ফুটবলের মধ্যেও বিজ্ঞান?
১৫ জুন ২০১০ফুটবলের মাঠে আজকাল আর কোনো কিছুই শুধু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া হয় না৷ খেলোয়াড় বাছাই, তাদের শারীরিক ক্ষমতা, প্রতিপক্ষের শক্তি ও দুর্বলতা থেকে শুরু করে মাঠের ঘাস, খেলোয়াড়দের পোষাক ও জুতো, ফুটবলের আকার-আয়তন – সব কিছুর পেছনেই অনেক ভাবনা চিন্তা কাজ করে৷ কোচ এই সব বিষয় খতিয়ে দেখে তারপর কৌশল স্থির করেন৷ তারই ফল দেখা যায় মাঠে৷ খেলোয়াড়দের মধ্যে সঠিক সমন্বয়, বলের গতি ও যাত্রাপথ সম্পর্কে আগাম ধারণা, বলের নির্দিষ্ট কোণে পায়ের সঠিক শট মেরে কোনাকুনিভাবে বল পাঠানো – এসবের পেছনেই রয়েছে বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্ব৷
ফুটবলের বৈশিষ্ট্য
জার্মানির ডর্টমুন্ড শহরের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক মেতিন তোলান ফুটবলের বৈজ্ঞানিক দিকগুলি সম্পর্কে অনেক ভাবনা-চিন্তা করেন৷ ফুটবলকে ভালোও বাসেন৷ মাঠে খেলোয়াড়ের ফ্রি-কিক থেকে বল সুন্দরভাবে শূন্যে ঘুরে যেভাবে গোলপোস্ট'এর দিকে ধেয়ে যায়, তা দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই৷ অধ্যাপক তোলান কিন্তু বিষয়টি দেখেন একজন বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে৷ তাহলে কি শূন্যে বল ঘোরার রহস্য জেনে অঙ্কের হিসেবে এমনভাবে বল মারা সম্ভব, যে গোল হবেই? ‘‘না এটা এই কারণে সম্ভব নয়, যে অঙ্ক করে বলের গতিপথ স্থির করা অত্যন্ত জটিল এক প্রক্রিয়া৷ টেবিল টেনিস বলের গতিপথ অঙ্ক করে বের করা তুলনামূলকভাবে সহজ, কারণ এই বলের মূল প্রতিরোধ হলো বাতাস৷ এই বলের ওজনও তেমন বেশি নয়৷ কিন্তু ফুটবলের ক্ষেত্রে বাতাসের বাধা এবং বলের ওজন – এই দুইয়েরই মাত্রা মোটামুটি এক৷ পদার্থবিদ্যার বিচারে যখনই কোনো দুটি ফল প্রায় একরকম হয়, তখন অঙ্ক অনেক বেশি জটিল হয়ে পড়ে৷''
গোলের সম্ভাবনা
দীর্ঘ ৯০ মিনিটের ফুটবল ম্যাচে সাধারণত গোলের সংখ্যা কিন্তু যথেষ্ট কম থাকে৷ মিনিটে বা প্রতি ৫ মিনিটে একটি করে গোল হলে কেমন হতো? খেলার কি কোনো মজা থাকত? অধ্যাপক তোলান মনে করেন, ‘‘আপনি দুঃখ করে বলতে পারেন, সত্যি – কেন যে এত কম গোল হয়! আমি কিন্তু মনে করি, ভাগ্যিস ফুটবল ম্যাচে এত কম গোল হয়! এমনটা হয় বলেই অনেক সময় অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল ম্যাচ জিতে যায়৷ কোনো ফাঁকে একটা গোল করে দিলেই হলো৷ প্রতিপক্ষ টিম শক্তিশালী হয়েও অনেক সময়ে সেই গোল শোধ করতে পারে না৷ এটা একেবারেই ন্যায্য নয় বটে, কারণ ভালো টিম সবসময়ে জিততে পারে না৷''
অন্যদিকে হ্যান্ডবল'এর ক্ষেত্রে কিন্তু শক্তিশালী টিমে জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি৷ সেখানে অনেক বেশি গোল হয়৷ বিষয়টা অনেক বেশি ন্যায্য, তা হলে কী হবে – হ্যান্ডবল'কে ঘিরে মানুষের আগ্রহ অনেক কম৷
দ্রুততার খেলা ফুটবল
ফুটবল মাঠে সময়ের দাম যে কতটা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলে খেলা৷ চারিদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়, পরিস্থিতি দ্রুত বুঝে নিতে হয়৷ সামান্য দেরি করলেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে৷ সেই অর্থে ফুটবল শুধু পায়ের নয়, মগজেরও খেলা৷ অধ্যাপক তোলান বললেন, ‘‘আমাদের মগজের কাজ করারও একটা নির্দিষ্ট গতি রয়েছে৷ খেলার মাঠে পরিস্থিতি বুঝে উঠতে সেকেন্ডের এক দশমাংশ সময়ের হেরফের হলে অফসাইড হয়ে যেতে পারে৷ সেকেন্ডের এক দশমাংশ সময়ে আমরা অন্ধ হয়ে যাই না – আমাদের মগজ তখন অন্য কোনো বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকে৷ ফলে কিছু ঘটলে তা দেখেও সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে৷ মাঠের পরিস্থিতিতে এক দশমাংশ সময়ে ৫০ সেন্টিমিটার দূরত্বে কিছু একটা ঘটে যেতে পারে৷''
পেনাল্টির রহস্য
ফুটবলের মাঠে পেনাল্টি কিক সুবর্ণ এক সুযোগ বয়ে আনতে পারে৷ তখন কোন খেলোয়াড়কে সামনে রাখা উচিত? সার্বিক কৌশলই বা কী হওয়া উচিত? অঙ্কের বিচারে কয়েক হাজার পেনাল্টি কিক'এর বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক তোলান মনে করেন, ‘‘যদি সবচেয়ে শক্তিশালী খেলোয়াড়কে সামনে রাখা হয়, তা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়৷ প্রথমে সবচেয়ে দুর্বল খেলোয়াড়কে সামনে রাখা উচিত, তারপর আরেকটু কম দুর্বল খেলোয়াড় – এভাবে এগোনো উচিত৷ কারণ পেনাল্টি কিক প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে৷ প্রথমেই শক্তিশালী খেলোয়াড়কে কাজে লাগালে পরের দিকে দুর্বল খেলোয়াড়কে দিয়ে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না৷''
অর্থাৎ ফুটবলের মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে বিজ্ঞানের নানা দিক৷ প্রথমে সেসব বিষয় সম্পর্কে সচেতন হয়ে, তারপর তার বিশ্লেষণ করে অনেক শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে৷ সব ক্ষেত্রে খেলোয়াড় কৌশল বদলাতে না পারলেও এই জ্ঞান অবশ্যই কাজে লাগতে পারে৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: অরুণ শঙ্কর চৌধুরী