পুরান ঢাকায় সেহরি পার্টি: উৎসবের আনন্দে সিয়াম সাধনা
পুরান ঢাকা পবিত্র রমজান মাসেও ভোজনরসিকদের বড় আকর্ষণ৷ গত কয়েক বছরে পবিত্র রমজানে সেখানে গড়ে উঠেছে ‘সেহরি পার্টির’ সংস্কৃতি৷ মধ্যরাতে পরিবার, বন্ধুদের নিয়ে সেখানে দলবেঁধে সেহরি খেতে যান অনেকে৷ ছবিঘরে দেখে নিন বিস্তারিত...
তরুণদের সমাবেশ
রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকে সেহরি খেতে যান পুরান ঢাকায়৷ উত্তরা, ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, ইস্কাটন ও মগবাজারের বাসিন্দারাই বেশি যান৷ তাদের বেশিরভাগই তরুণ৷ সেহরি পার্টির সুবাদে কিছুক্ষণ একসঙ্গে সময় কাটান তারা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও দেখা যায় সেখানে৷ ওপরের ছবিটি কাজী আলাউদ্দিন সড়কের৷
জমজমাট আড্ডা
রাতের ঢাকায় যানজটের ঝামেলা নেই৷ তাই মাঝে মাঝে সেহরিতে মুখরোচক খাবারের স্বাদ নিতে পুরান ঢাকায় যান অনেকে৷ সেখানে সমবয়সি এবং সমমনাদের আড্ডাও জমে ভালো৷ নাজিরা বাজারে একটি চায়ের দোকানের সামনে সেই চিত্রই দেখা যায়৷ দল বেঁধে যাতায়াত করা হয় বলে নিরাপত্তা নিয়ে অতটা শঙ্কা কাজ করে না কারো মনে৷
গাড়ির সারি
মধ্যরাত থেকে শুরু করে সেহরি পর্যন্ত পুরান ঢাকার বিভিন্ন হোটেলের সামনে গাড়ির সারি চোখে পড়ে৷ ভোজনরসিকদের অনেকে ব্যক্তিগত যান ও মোটরসাইকেলে সেখানে যান৷ আশপাশের লোকজন বেছে নেন রিকশা৷ প্রতিটি হোটেলের নিরাপত্তাকর্মীরাই মূলত যানবাহনগুলো দেখে রাখেন৷ আল রাজ্জাক রেস্টুরেন্টের সামনের চিত্র এটি৷
আগেভাগে খাওয়া
সেহরির শেষ সময় রাত ৪টার পর হলেও পুরান ঢাকার হোটেলে রাত ১২টা থেকে শুরু হয়ে যায় সেহরি পার্টি৷ বসার জায়গা পেতে অনেকে আগেভাগে খেতে বসে যান৷ ফলে মধ্যরাত থেকেই চোখে পড়ে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ৷ আল রাজ্জাক রেস্টুরেন্টে সেরকম কয়েকজনকেই দেখা গেলো৷
নতুন অভিজ্ঞতা
বন্ধু কিংবা পরিচিতিদের অভিজ্ঞতা শুনে পুরান ঢাকার সেহরি পার্টির প্রতি আকৃষ্ট হন অনেকে৷ তাদেরই একজন ধানমন্ডির বাসিন্দা মায়া৷ তিনি এ-লেভেল পরীক্ষা দিয়েছেন৷ আল রাজ্জাক রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে তিনি ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘প্রথমবার পুরান ঢাকায় সেহরি খেতে এসেছি৷ অনেক ভালো লাগলো৷ পুরো নতুন অভিজ্ঞতা৷ রসনার জন্য পুরান ঢাকার সত্যি তুলনা নেই৷’’
জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টগুলো
পুরান ঢাকায় বংশালের নর্থ সাউথ রোডে আল রাজ্জাক রেস্টুরেন্ট, ঠাটারি বাজারের বি.সি.সি. রোডে হোটেল স্টার, ওয়ারি সংলগ্ন জয়কালী মন্দিরে হোটেল সুপার, রায় সাহেব বাজারে হোটেল স্টার এবং আদি ইসলামিয়া এবারের রমজান মাসে খোলা রয়েছে৷ এছাড়া পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলিগলির হোটেলে সেহরি করেন অনেকে৷
সবার প্রিয় বিরিয়ানি
সেহরি পার্টিতে বেশি জনপ্রিয় পুরান ঢাকার বিরিয়ানি৷ কাজী আলাউদ্দিন রোডে হাজী বিরিয়ানি, হানিফ বিরিয়ানি, হাজী নান্না বিরিয়ানিসহ বিভিন্ন বিরিয়ানির দোকানগুলোতে শেষ রাত পর্যন্ত ভিড় লেগে থাকে৷ অনেকে বিসমিল্লাহ কাবাব ও মামা কাচ্চি অ্যান্ড কাবাব হাউজে ঢুঁ মারেন৷ ইফতার থেকে শুরু করে সেহরি পর্যন্ত খোলা থাকে বিরিয়ানি ও কাবাবের দোকান৷
যেসব দিনে বেশি ভিড়
রমজানে সেহরি পার্টি উপলক্ষে আলাদাভাবে দুই-একটি হোটেলে আলোকসজ্জা দেখা গেছে৷ ছবিতে ঠাটারি বাজারের হোটেল স্টার৷ পুরান ঢাকায় সেহরি পার্টিতে সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার বেশি ভিড় হয়৷ তবে করোনা মহামারির পর আগের চেয়ে ক্রেতা সমাগমে কিছুটা ভাটা পড়েছে৷
আহারে বৈচিত্র্য
সেহরির জন্য বিভিন্ন হোটেলে রাত ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত খাবার রান্না হয়৷ একেকজন বাবুর্চি একেক পদ তৈরি করেন। এছাড়া ইফতারের পর থেকে জমে ওঠে বিরিয়ানি কেনাবেচা৷ ওপরে আল রাজ্জাক রেস্টুরেন্টে ছবি৷
ঐতিহ্যবাহী খাবার
সেহরির মেন্যুতে পাওয়া যায় পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী অনেক ধরনের খাবার৷ সাদা ভাতের সঙ্গে খাসির পা, খাসির রেজালা, খাশির রোস্ট, খাসির গ্লাসি, আনাম (আস্ত) মুরগি, ডাল, মুরগি মাসাল্লাম, ঝাল ফ্রাই রো কত কী! বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় মাছ, নানা পদের ভর্তা ও সবজিও থাকে মেন্যুতে৷ এর বাইরে বিরিয়ানি, তেহারি, কাচ্চি আর মোরগ-পোলাও তো আছেই৷
ওয়েটারদের কথা
সেহরি পার্টিতে ব্যস্ত সময় কাটান ওয়েটাররা৷ রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে টেবিলে টেবিলে পরিবেশনের পাশাপাশি ভোজনরসিকদের তৃপ্তি দিতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেন না তারা৷ ইফতার থেকে শুরু করে সেহরি পর্যন্ত ডিউটি করেন তারা৷ ছবিতে আল রাজ্জাক রেস্টুরেন্টের ওয়েটাররা৷
বাইরেও বসার ব্যবস্থা
দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়৷ তখন হোটেল মালিকরা পরিসর বড় করে থাকেন৷ নিম্ন আয়ের মানুষদের উপযোগী অলিগলির ছোটবড় রেস্তোরাঁয় এমন দৃশ্য চোখে পড়ে৷ কাজী আলাউদ্দিন রোড সংলগ্ন আলুবাজারের একটি হোটেলে এভাবে বাইরে চেয়ার-টেবিলে বসে সেহরি চলছে৷
অন্যদেরও আয়ের সুযোগ
সেহরি পার্টিকে ঘিরে অন্যরাও আয়ের সুযোগ পান৷ প্রতিটি হোটেলের কাছে চা, সিগারেট ও পানের দোকান আছে৷ খাওয়া সেরে এসব দোকানে ভিড় করেন অনেকে৷ ফেরিওয়ালারাও ঘোরাঘুরি করেন হোটেলের আশেপাশে৷ ঠাটারি বাজারে হোটেল স্টারের সামনের ছবি৷
গরমে লাচ্ছি-জুসে প্রশান্তি
গরমে মন জুড়াতে কাজী আলাউদ্দিন রোডে ঐতিহ্যবাহী বিউটি লাচ্ছিতে ভিড় জমে উঠছে৷ আগামী জুনে প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপন করবে দোকানটি৷ এখানে লাচ্ছি প্রতি গ্লাস ৪০ টাকা৷ একই সড়কে আল-কারিম জুস বারে ইফতার থেকে শুরু করে সারারাত বেচাকেনা চলে৷
শুরুর কথা...
পুরান ঢাকায় সেহরি পার্টি ঠিক কবে শুরু হয়েছে সেই তথ্য ঠিকঠাক পাওয়া গেল না৷ তবে রমজানে সেহরির কথা ভেবে ব্যবসায়ী, কর্মচারী এবং আবাসিক হোটেলের অতিথিদের সুবিধার্থে এখানকার রেস্তোরাঁ সারারাত খোলা থাকতো অনেকে আগে থেকেই৷ রোজাদারদের সমাগমে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সেহরি পার্টি৷