মেয়েটিকে ওরা বক্সখাটে লুকিয়ে রাখতো
২০ অক্টোবর ২০১৫ওকে বাড়ির ছোট-বড় সবাই মারতো৷ লাঠি, খুন্তি, খেলনা গাড়ি – বলতে গেলে হাতের কাছে যা পাওয়া যেতো তা দিয়েই মারতো৷ ঘা হয়ে গেল গায়ে৷ চিকিৎসা করায়নি৷ আহার জুটতো না৷ ক্ষুধায় কাতর হয়ে মুখ ফুটে বললে অন্যের উচ্ছিষ্ট খাবার দেয়া হতো, তা দিয়েই ক্ষুধা মেটাতো কল্পনা৷ অত্যাচারে জর্জরিত, অনাহারে শীর্ণ মেয়েটিকে বক্সখাটে লুকিয়ে রাখা হতো৷ বাইরের কেউ দেখে ফেললে যে দুর্নাম হবে!
ডয়চে ভেলে:এই পর্যন্ত কয় বাসায় কাজ করেছো ?
কল্পনা: প্রথমে এক বাসায় ছিলাম৷ তারা আমাকে খুব আদর করতো, কারণ, তাদের কোনো সন্তান ছিল না৷ তারা খুব আদর-যত্ন করতো৷
যেই বাসায় তোমাকে এত আদর করতো সেই বাসাটা ছেড়েছো কেন?
ওই বাসায় আমার যে মালিক ছিল তাকে কতগুলা লোক মাইরা ফেলসে৷ পরে আমি ভয়ে ওই বাসা থেকে আইসা পড়ছি৷
ও তাদেরকে মেরে ফেলসে? তারপর তুমি আরেক বাসায় কাজ নিলা৷ সেই বাসায় তারা কী করতো?
তারা আমাকে দিয়া তিন বেলা ঘর মুছাইতো৷ নীচতলা থিকা গরম পানি দোতলায় আনাইতো৷ ছেলে-মেয়েকে খাওয়া-দাওয়া করাইতো, গোসল করাইতো আর একটু কিছু হইলেই আমাকে মারতো৷
বেতন কত দিতো ?
বেতন দিতো না৷
খালি খাওয়াইতো?
খাওয়াইতো না৷ না খাওয়াইয়া রাখতো৷ খাবার চাইলে আমাকে নীচের ঝুটা ভাত খাওয়াইতো৷
মারতো কেন? কাজে ভুল হইলে মারতো?
না, আমি কাজ ঠিকমতো করতাম৷ ওনার দুইটা ছেলে আছে, তারা ঘরে ময়লা ফালাইলে ওই ছেলেদেরকে কিছু বলতো না, কিন্তু আমাকে আইসা মারতো৷
কী দিয়ে মারতো? খালি হাতে?
মোটা লাঠি দিয়া৷
কে মারতো? যেই সাহেব ছিল সেই সাহেব, নাকি বেগম সাহেব?
দুইজনই৷
ছেলেও মারতো?
হ্যাঁ৷ খেলনা গাড়িগুলা আছে না? স্টিলের সেই গাড়িগুলা দিয়া আমাকে মারতো৷ ওই গাড়ি চ্যাপ্টা কইরা আমার হাত কাইট্টা দিতো৷ পরে মাথায় পোচাইতো৷ নীচে পাকার উপর বাইড়াইতো৷
বাবা-মা তারে কিছু বলতো না?
না, দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখতো৷
এইরকম মারপিট খেয়ে তুমি ওই বাড়িতে কতদিন কাজ করসো?
প্রায় পাঁচ মাস ছিলাম৷ তারপর আমি পাশের বাসার বাড়িওয়ালাকে জানাই৷ তারা আমাকে রুমে আটকাইয়া থুইয়া বেড়াইতে যাইতো৷ পরে আমাকে খুব অত্যাচার করতো৷ আমাকে খাইতে দিতো না৷ তখন আমি খুব কষ্টে ছিলাম৷ পরে আমি যখন জ্বালা সহ্য করতে পারি না, তখন পাশের বাসায় জানাইসি৷ তারা সেদিন রাত্রে বাড়িওয়ালারে বইলা দিসে যে আমি বলসি৷ তারপর তারা আমাকে খুব মারসে৷ খুন্তি দিয়া মাথায় মারসে৷ সেফটি পিন দিয়া পায়ে ফুটা কইরা দিসিলো৷ তাদের বাসায় কেউ আসলে আমাকে ওই যে বক্সখাটগুলা আছে, ওই খাটের ভিতরে আটকাইয়া রাখতো৷
কেন আটকাইয়া রাখতো?
আমার গায়ে অনেক দাগ ছিল৷ তারা যে মারতো, মারার পরে যে পাইকা পাইকা পুজ পড়তো, সেইগুলি অন্যরা দেখবে বইলা আমারে বক্সখাটে লুকাইয়া রাখতো৷ আর কেউ যখন জিজ্ঞেস করতো, ‘‘তোমাদের বাসায় কি কোনো কাজের মেয়ে নাই?'' বলতো, ‘‘না, আমরা কোনো কাজের মেয়ে রাখি না৷''
তোমাকে যে সিঁড়ি থেকে ফেলে দিতো, তখন আশপাশের লোকজন কিছু বলতোনা?
সিঁড়ি দিয়া ফালাইতো, ওই পাশে একটা ভাড়াইট্টা আছে, সেই ভাড়াইট্টা যদি কিছু বলতো, তাদেরকে ধমক দিতো, বলতো, ‘আপনার কী? আমাদের কাজের মেয়েকে আমরা মারি তাতে আপনার কোনো সমস্যা হয়?' এইভাবে তাদেরকে ধমক দিয়া বসাইয়া রাখতো৷
তো এইরকম চলছিল, একদিন তুমি নীচতলার বাড়িতে গিয়া সব কিছু বললা?
না, নীচতলায় না৷ আমাকে একটা রুমে আটকাইয়া রাইখা তারা দুইদিন বিয়ের বাড়িতে দাওয়াত খাইতে গেসিলো৷ ওই ঘরে একটা জানালা আছে, ওই জানালা আমি খুলসি, খুইলা দেখি একটা মহিলা৷ আমি সেই মহিলাকে ডাকসি৷ তাকে সব কিছু বলসি৷ আমাকে কীভাবে অত্যাচার করসে, কেন করসে – সব বলসি৷ বলার পরে তারা সন্ধ্যা সাতটার সময় পুলিশকে খবর দিসে৷
তোমারে যারা মারতো তারা এখন কই?
তারা কই সেইটা আমি জানি না৷
তাদের বিরুদ্ধে মামলা-টামলা হইসে কিনা, তাদেরে পুলিশ ধরসে কিনা এইগুলি জানো না?
মামলা হইসে৷ মামলা আমিই করসি৷
গায়ের দাগগুলো গেসে? ঘা শুকাইসে?
দাগগুলা এখনো আছে৷ কিন্তু পিঠে যে লাঠির দাগগুলা ওইগুলা চইলা গেসে৷ এখনো পায়ে সেফটি পিনের ফুটাগুলি আছে৷
তুমি এখন লেখাপড়া করতেসো?
জ্বি৷
লেখাপড়া করে কী করবা?
আমার স্বপ্ন আমি বাচ্চাদেরকে পড়াবো৷ আমি টিচার হবো৷
আর বড়দেরকে কিছু বলবা না? শুধু বাচ্চাদেরকে পড়াবা? যারা বাচ্চাদেরকে বাড়িতে কাজ করতে নিয়ে গিয়ে মারে – তাদেরকে কিছু বলবা না?
হ্যাঁ, আমি প্রতিবাদ করবো৷ লড়াই করবো৷ তাদেরকে বলবো, এইগুলা করতে হয় না, তারা এখনো ছোট৷
(নিরাপত্তা এবং আইনের দিক বিবেচনা করে নির্যাতিতার নাম, পরিচয়, ঠিকানা গোপন রাখা হয়েছে৷ কল্পনা নামটি কাল্পনিক৷ একটি মানবাধিকার সংস্থা মেয়েটির মামলা পরিচালনা ও দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে৷)
কল্পনার মতো গল্প কি আপনাদেরও চোখে পড়েছে? জানিয়ে দিন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷