1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১৯ জানুয়ারি ২০১৮

ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে গুরু-শিষ্য পরম্পরা এখন যেন অতীত৷ উল্টে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্যের নমুনা মিলছে অহরহ৷ এটা কি নিছকই প্রশাসনিক সমস্যা, না এর নেপথ্যে রয়েছে সমাজের সামগ্রিক অধঃপতনের প্রতিচ্ছবি?

https://p.dw.com/p/2r7yg
ছবি: DW/P. Samanta

নতুন বছরের শুরুতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাধিক গণ্ডগোলের ঘটনা এই প্রশ্নটিকে সামনে এনে দিয়েছে৷ বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে চারুচন্দ্র ও দেশবন্ধু কলেজ৷ ছাত্র এবং শিক্ষক, দুই শিবিরই জড়িয়ে পড়েছে বিতণ্ডায়৷ চারুচন্দ্র কলেজে একজন নিরাপত্তারক্ষীকে কেন্দ্র করে ছাত্র সংসদের পদাধিকারীদের নেতৃত্বে অধ্যক্ষকে ঘেরাও করে রাখা হয়৷ অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষকদের হেনস্থার পাশাপাশি প্রবীণ অধ্যাপক সমীর বেরা এবং অশিক্ষক কর্মী রঞ্জিত ঘরাইকে মারধর করে আন্দোলনকারীরা৷ পরে ঘেরাও মুক্ত হয়ে পাল্টা আন্দোলনে নামে শিক্ষক মহল৷ বন্ধ হয় কলেজের দরজা৷ পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে হস্তক্ষেপ করতে হয়৷

উপস্থিতির হার কম থাকায় দেশবন্ধু কলেজের ছাত্রীদের পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেওয়া হয়নি৷ তার প্রতিবাদে চেয়ার ভাঙা, পোস্টার ছেঁড়ার পরে অধ্যাপককে কিল-ঘুসি মারার অভিযোগ উঠেছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, পরীক্ষায় বসতে গেলে ৬০ শতাংশ উপস্থিতি প্রয়োজন৷ গত নভেম্বরে অভিভাবক ও শিক্ষকদের বৈঠকে সে কথা জানানো হয়েছিল কর্তৃপক্ষের তরফে৷ কিন্তু দেশবন্ধু কলেজ ফর গার্লস-এর অধিকাংশ ছাত্রীরই উপস্থিতির হার কম থাকায় তাঁদের পরীক্ষায় বসতে দিতে নারাজ ছিল কর্তৃপক্ষ৷ কিন্তু ক্লাস না করা পড়ুয়াদের দাবি, তাঁদের পরীক্ষায় বসতে দিতে হবে৷ ছাত্রীদের আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে কলেজ৷ পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয় বিক্ষোভকারীদের৷ অভিযোগ, বাণিজ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ওমপ্রকাশ চৌধুরীকে কিল-ঘুসি মারা হয়েছে৷

অধ্যাপক নিগ্রহ, শিক্ষক হেনস্থার যে সংস্কৃতি পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে, তার নজির কেবল কলকাতায় নয়, সারা রাজ্যেই দৃশ্যমান৷ কখনও তৃণমূল নেতার স্ত্রী'র টোকাটুকি ধরে ফেলায় কলেজের অধ্যক্ষ মার খাচ্ছেন, তো কখনও মদ্যপ অবস্থায় পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে যেতে বললে টিএমসিপি নেতা শিক্ষিকাদের ‘রেপ’ করানোর হুমকি দিচ্ছেন৷ অধ্যাপকদের বেধড়ক মারধর, কখনও অধ্যক্ষকে রড, চেন দিয়ে পেটানোর অভিযোগও উঠছে এ রাজ্যের কলেজগুলিতে৷ রায়গঞ্জ, মালদা, ইটাহার, ভাঙড়ের কলেজ থেকে প্রেসিডেন্সি, আলিয়া, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়— কোথায় নেই এই নৈরাজ্যের নমুনা! রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি মতো পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুরই৷ কিন্তু নৈরাজ্যের এমন নজির কি সত্যিই অপরিবর্তনীয়? এমন পরিস্থিতি শিক্ষার জন্য কতটা আদর্শ?

আজকের পরিস্থিতিতে ছাত্র সংগঠন টাকা খরচের যন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে: শিক্ষাবিদ

শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার মনে করেন, এমন পরিস্থিতি সমাজ এবং শিক্ষাঙ্গন উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর৷ রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর কতটা বদলেছে বাংলার শিক্ষা জগত? ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘বাইরের অনেক প্রভাবের জন্যই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আজ অবনতির দিকে৷ আজকের পরিস্থিতিতে ছাত্র সংগঠন টাকা খরচের যন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ভুল রাজনীতি আর বহিরাগতদের প্রভাবের দরুণ এই সমস্যার সৃষ্টি৷’’

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান সনৎ নস্কর এ ব্যাপারে অবশ্য রাজনীতির অনুপ্রবেশকেই বড় করে দেখছেন৷ ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে আগে যে দূরত্ব বা সমীহের স্থান ছিল, এখন হয়তো তা নেই৷ কিন্তু তা বলে এই সম্পর্কের যে ব্যাপক অবনতি হয়েছে তা তিনি মানতে চান না৷ তাঁর মতে, ‘‘সমাজ ও পরিবেশ বিচার করে আরও বলা যায়, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আজকের ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের ভিত্তি হলেও তারও সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত৷ উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ছাত্রদের অধ্যাপকের উপরে চড়াও হওয়া উচিত নয়৷’’ স্বার্থের খাতিরে অধ্যাপকদের সঙ্গে অভব্য আচরণ করলেও ছাত্রদের ভেতরে সেই শ্রদ্ধাটা আছে বলেই মনে করেন এই অধ্যাপক৷

রাজনীতিই ছাত্রদের মন বিষিয়ে দিচ্ছে: সনৎ নস্কর

ছাত্র আন্দোলন প্রসঙ্গে সনৎ নস্করের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ, কেননা সরাসরিই তিনি এর আঁচ টের পেয়েছেন৷ গত এপ্রিলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ছাত্রনেতা কায়ুম মোল্লার অভব্য আচরণের শিকার হয়ে কলা বিভাগের ফ্যাকাল্টি সেক্রেটারি মউ দাশগুপ্ত পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ইস্তফাপত্র পাঠিয়েছিলেন৷ পরের দিন বাংলা বিভাগের প্রধান সনৎ নস্করও পদত্যাগ করেন৷ পরে ওই ছাত্রনেতা উপাচার্যের হস্তক্ষেপে মউ দাশগুপ্তের কাছে ক্ষমা চাইলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়৷ এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক নস্কর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই নির্দিষ্ট ঘটনায় রাজনীতির প্রভাবই ছিল মুখ্য৷ সংখ্যা গরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু এর পেছনে ছিল না৷ রাজনীতিই ছাত্রদের মন বিষিয়ে দিচ্ছে৷ রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত না হলে ছাত্ররা এতটা আগ্রাসী হয় না৷ ক্লাসের মধ্যে এখনও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ভালো৷ এখনও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনো করতে চায়, শিখতে চায়৷’’

ছাত্র রাজনীতি শাসকদলের প্রভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এমনটা মনে করছেন বাম ছাত্র সংগঠনের নেতারা৷ ডিএসও-র কলকাতা জেলা কমিটির সদস্য মিজানুর মোল্লার বক্তব্য, ‘‘তৃণমূল ছাত্র পরিষদ পকেট ভরানোর রাজনীতি করছে৷ আমরা এই হঠকারিতাকে অরাজনীতি বলে থাকি৷ শাসক দলের মদতে নানা অরাজনীতিমূলক কাজ চলছে৷’’ চারুচন্দ্র বা দেশবন্ধু কলেজ সম্পর্কে তাঁর মত, ‘‘এ ক্ষেত্রে শালীনতা বজায় রাখা উচিত ছিল৷ শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলাটা অন্যায়৷ শিক্ষকদের সঙ্গে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক না থাকলে পড়াশুনোটা হবে কী করে? তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন ওসব আদর্শের ধার ধারে না৷’’

বহু ক্ষেত্রে এ ধরনের গণ্ডগোলের নেপথ্যে বহিরাগতদের হাত থাকার অভিযোগ উঠে আসে৷ এমনকি, চারুচন্দ্র কলেজের ক্ষেত্রেও শিক্ষামন্ত্রী বহিরাগতের তালিকা পেয়েছেন৷ তাঁর বক্তব্য, কলেজে তাণ্ডবে অভিযুক্তদের কেউ সেখানকার পড়ুয়া নয়, বহিরাগত৷ শিক্ষকদের কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শিক্ষকদের যদি নিরাপত্তাহীনতার এত অভিযোগ থাকে, তা হলে তাঁরা শিক্ষা দফতরকে জানাচ্ছেন না কেন? সরকার যখন ঘেরাও-অবস্থান থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মুক্ত করতে চাইছে, তখন শিক্ষকরা এই ভূমিকা নিলে কী বলা যায়?’’ এক্ষেত্রে মিজানুরের মন্তব্য, ‘‘বহিরাগতরা আই কার্ড ছাড়া কলেজে ঢুকছে কী করে? এর পছনে যে শাসকদলের মদত রয়েছে, তা তো স্পষ্ট, শিক্ষামন্ত্রী যা-ই বলুন না কেন!’’

পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র রাজনীতির মানের অবনতি হয়নি: টিএমসিপি নেত্রী

এসব ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা ঠিক কতটা? সনৎ নস্কর মনে করেন, ‘‘ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের সংঘাত বাধে প্রশাসনিক স্তরে কাজকর্মের ক্ষেত্রে৷ সেখানেই রাজনীতি ছাত্রদের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়৷ ক্লাসরুমে জ্ঞানচর্চার মধ্যে তেমন সমস্যা নেই৷’’ তবে পবিত্র সরকার মনে করেন, ‘‘প্রশাসনিক স্তর ছাড়িয়েও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে এর আঁচ এসে পৌঁছেছে৷ মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষাঙ্গনে পরিবর্তন আনতে চেয়ে যা-ই বলে থাকুন না কেন, ছাত্ররা মোটেই সে দিকে কান দিচ্ছে না৷’’

এত কিছুর পরও শিক্ষাঙ্গনে অচলাবস্থার কথা স্বীকার করতে চাইছে না শাসকদলের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ টিএমসিপি৷ সংগঠনের রাজ্য সভানেত্রী জয়া দত্তের বক্তব্য, ‘‘দেশবন্ধু কলেজে অধ্যাপক নিগ্রহ করেছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা৷ এর সঙ্গে টিএমসিপি-র যোগ নেই৷ আমরা বিক্ষুব্ধ পড়ুয়াদের সঙ্গে বরং কথা বলেছি৷ তাঁদের বুঝিয়েছি, এটা সঠিক পথ নয়৷’’ জয়ার দাবি, পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র রাজনীতির মানের অবনতি হয়নি৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ঘেরাও, গেটে অবস্থান এখন আর হয় না৷ ৫০০-৬০০ কলেজের মধ্যে দু'একটির ঘটনা প্রমাণ করে না যে, শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য রয়েছে৷

গত আগস্টের ছবিঘরটি দেখুন...