পথে বসেছেন ওঁরা
৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯‘জন্মের পর মায়ের কোলে চড়ে যে বাড়িতে ঢুকেছিলাম, রাতারাতি সেখান থেকে বেঘর হতে হল৷ কী আর বলব, বলুন!এখন কাজকর্ম ফেলে রোজ এসে এই উল্টোদিকের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকছি৷ বাড়িটার খেয়াল রাখছি৷ আর তো কিছু করার নেই এখন!'
কথাটা বলতে বলতে চোখ ছলছল করে উঠল সঞ্জীব বড়ালের৷ ছোটবেলা থেকে যে পাড়ায় বাস, ওঁর ছেলেরও জন্ম, বড় হয়ে ওঠা যেখানে, সেই গোটা এলাকাটা এখন ‘বিপজ্জনক'৷ পুলিস ব্যারিকেড করে রেখেছে পর পর চারটে গলির মুখ৷ বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে হেলে পড়া, ভেঙে যাওয়া বাড়িগুলো৷ কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না৷ তার পরেও খালি ব্যাগ হাতে গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছেন প্রচুর মানুষ, বিশেষত মহিলারা৷ যদি একবার ভেতরে যেতে দেয়, যদি কিছু জিনিস বাড়ির ভেতর থেকে উদ্ধার করে আনা যায়৷ আর সঞ্জীবের মতো অসহায় লোকজন উল্টোদিকের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছেন বাড়িগুলোর দিকে৷ বাসিন্দাদের ঢুকতে না দিলেও যদি উটকো কেউ ঢুকে পড়ে ফাঁকতালে! যদি কিছু চুরি হয়ে যায়৷ মাত্র পাঁচ মিনিটের নোটিসে বেরিয়ে আসতে হয়েছে এক কাপড়ে৷ প্রায় কিছুই সঙ্গে আনতে পারেননি৷
মধ্য কলকাতার বৌবাজার এলাকার বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট৷ দুধারে পর পর সোনার গহনার দোকান৷ বড় রাস্তা থেকে পর পর ঢুকে গেছে গলিগুলো৷ ঘন জনবসতি এলাকার পরিচিতি স্যাকরাপাড়া হিসেবে৷ বহু মানুষের বাস৷ এই এলাকারই মাটির নিচে মেট্রো রেলের সুড়ঙ্গ খোঁড়া হচ্ছিল৷ হঠাৎই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে ওপরের কয়েকটা বাড়ি৷ বড় বড় ফাটল দেখা দেয় আরও বেশ কিছু বাড়িতে৷ মোট ৩২টা বাড়ি৷ গোটা একটা পাড়া৷ অনেকগুলো মানুষ৷ খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ আপাতত এককালীন পাঁচ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে এক একটি পরিবারকে৷ অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা হয়েছে কাছাকাছির হোটেলে৷
একটা কথা শোনা যাচ্ছে, যে হাওড়া এবং কলকাতাকে জুড়ে দেওয়ার জন্য হুগলি নদীর তলা দিয়ে যে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ চলছিল, তার মূল নকশায় বৌবাজারের এই পুরনো পাড়ার তলা দিয়ে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কথা ছিল না৷ কিন্তু যে রুট আগে ঠিক হয়েছিল, সেখানকার কিছু দোকানদার এবং ব্যবসায়ী আপত্তি তোলেন৷ আদালতে চলে যান ওঁরা৷ ২০১৩ সালের সেই বিরোধে বর্তমান রাজ্য সরকারের থেকেও সহযোগিতা পাওয়া যায়নি৷ ফলে মেট্রোর রুট ঘোরাতে হয়৷ তার পর এই বিপত্তি৷
মামলার কথাটা তাঁদের জানা ছিল না৷ বলছেন স্থানীয় বাসিন্দা আশিস সেন৷ কিন্তু তিনি বলছেন, এটা ‘ম্যান মেড ডিজাস্টার'৷ অর্থাৎ মেট্রো কর্তৃপক্ষের কারণেই এই বিপর্যয়৷ নয়ত মেট্রো ক'দিন আগে পাড়ায় এসে কেন বলেছিল, যে তিন-চারদিনের জন্যে বাড়ি খালি করে চলে যেতে?ওই অংশে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ হলে আবার ফিরে আসতে?ওরা নিশ্চয়ই আন্দাজ করেছিল যে কিছু একটা হতে পারে!বলছেন আশিস সেন৷ আর মেট্রো কর্তৃপক্ষ কী বলছে?কাছেই গোয়েঙ্কা কলেজের ভেতর মেট্রো রেল অস্থায়ী দপ্তর খুলে রোজ বসছেন মেট্রোর আধিকারিকরা৷ তাঁদের ঘিরে ধরে দিনভর এলাকার মানুষের লাগাতার বিক্ষোভ৷ আলাদা করে কিছু বলার অবস্থায় নেই ওঁরা৷ যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত৷
স্যাকরাপাড়া লেন, দুর্গা পিতুরি লেন-এর মতো যে রাস্তা এবং এলাকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত, তার আসপাশের এলাকা এখন একইরকম সন্ত্রস্ত৷ কারণ আরও ২২টা বাড়িতে ফাটল দেখা গেছে৷ এদিকে মেট্রোর সুড়ঙ্গ খোঁড়ার যন্ত্রটি চাপা পড়ে আছে মাটির নিচে৷ বহু কোটি টাকা দামের সেই বিদেশি খননযন্ত্রটি উদ্ধারের চেষ্টা করলে আরও বিপত্তি হতে পারে৷ আর এই সব মিলিয়ে আরও অন্তত এক বছর পিছিয়ে গেল ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ, যা আগে থেকেই ঢিমে তালে চলছিল৷