নুসরতের পুষ্পাঞ্জলি নিয়ে পক্ষ বিপক্ষ
১২ অক্টোবর ২০১৯ধর্ম যার যার উৎসব সবার— এই স্লোগান জনপ্রিয় হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে এই স্লোগান তুলে প্রচার চালানো হচ্ছে পুজোর সময়৷ মৌলবাদীদের এই প্রচার পছন্দ হওয়ার কথা নয়৷ নুসরতের অঞ্জলি সেই ব্যাপারটাই সামনে এনে দিল৷ তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ নুসরত এবার দুর্গাপুজোয় কলকাতার সুরুচি সঙ্ঘের মণ্ডপে যান৷ স্বামী নিখিল জৈন সঙ্গে ছিলেন৷ মণ্ডপে ছিলেন চিত্র পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় ও পুজো উদ্যোক্তা রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস৷ এখানে সকলের সঙ্গে অঞ্জলি দেন নুসরত৷ সেই ছবি ও ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়৷ এতে রুষ্ট মুসলিম মৌলবিরা৷ তাঁদের বক্তব্য, ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়ে কীভাবে নুসরত প্রতিমার সামনে প্রার্থনা করলেন৷ তিনি ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন৷ মুসলমান হয়েও ধর্মের অবমাননা করেছেন৷
নুসরতকে ঘিরে এই বিতর্ক নতুন নয়৷ নিখিল জৈনের সঙ্গে বিয়ের পর তিনি শাঁখা-সিঁদুর পরে সংসদে গিয়ে শপথ নেন৷ তখন একপ্রস্থ বিতর্ক হয়েছিল৷ তার পর অভিনেত্রী বলেছিলেন, ধর্মবিশ্বাসে তিনি মুসলমানই৷ এবার অঞ্জলি দেওয়ায় সেই বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে৷ বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিন নুসরতের পাশে দাঁড়িয়েছেন৷ ৭ অক্টোবরের ট্যুইটে তিনি বলেছেন, ‘‘অমুসলমান হয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন হিজাব পরে প্রার্থনা করেন, তখন মুসলিম ধর্মগুরুরা খুশি হয়ে তাঁকে ধর্মনিরপেক্ষ বলেন৷ যখন অহিন্দু নুসরত পুজোর সময় প্রার্থনা করেন, তখন মুসলিম ধর্মগুরুরা অখুশি হন ও এই কাজকে ইসলামবিরোধী তকমা দেন৷''
রাজনৈতিক কর্মী ও চিকিৎসক রেজাউল করিম নুসরতের পক্ষে সওয়াল করেছেন৷ গত সাধারণ নির্বাচনে বাম প্রার্থী রেজাউল বলেন, ‘‘একটি স্বাধীন দেশের একজন নারী কোনো ধর্ম পালন করবেন, নাকি নাস্তিক থাকবেন, সে ব্যাপারে মোল্লা, পুরোহিত, যাজকের ফতোয়া জারি করার অধিকার নেই৷ কে তাদের এই দায়িত্ব দিয়েছে৷ নুসরত অঞ্জলি দিয়ে কোনো ভুল করেননি৷ আমি এগারো ক্লাসে পড়ার সময় থেকে অঞ্জলি দিই৷ আমার মেয়েরাও দেয়৷'' রেজাউলের মতে, ‘‘দুর্গাপুজো নিছক কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এখানে উৎসবটাই প্রধান৷ বারোয়ারি পুজো সেভাবেই হয়৷ ঘরের মেয়ে হিসেবে দেখা হয় দুর্গাকে৷ এটাই বাংলার সংস্কৃতি৷ বাঙালি হিসেবে নুসরত ঠিক কাজই করেছেন৷''
কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু মানুষ পুজোয় অংশ নেন৷ দর্শনার্থী হিসেবে নয়, পুজো পরিচালনার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকেন তাঁরা৷ মুর্শিদাবাদের এক বিধায়ক প্রতিবারের মতো এ বছরও নিজে হাতে দুর্গা প্রতিমা তৈরি করেছেন৷ অবাঙালি সংখ্যালঘুরাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই৷
কলকাতার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত খিদিরপুরে একটি ক্লাবের পুজোর প্রধান কর্তারা মুসলমান৷ বিবিধের মাঝে মিলনের ভারতীয় পরম্পরার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন কলকাতা পৌরসভার কাউন্সিলর রেহানা খাতুন ৷ শহরের প্রথম সারির পুজো মহম্মদ আলি পার্কের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত তিনি৷ তাঁর ওয়ার্ডের ১৬-১৭টি পুজোর তত্ত্বাবধান করেন তিনি৷ বলেন, ‘‘পুজোর একমাস আগে থেকে প্রস্তুতি নিই৷ কোন কমিটির কোথায় সমস্যা আছে দেখি৷ অনেক রাত পর্যন্ত মেডিক্যাল ক্যাম্প চালাই৷ খাওয়াদাওয়ার অনুষ্ঠানে থাকি৷'' জনপ্রতিনিধি রেহানা উৎসব নিয়ে বিভেদের ঘোর বিরোধী৷ তাঁর মতে, ‘‘আমি মুসলমান, নামাজ পড়ি৷ আমার কাছে সব ধর্ম একই৷ যিনি আল্লা, তিনিই গড৷ এ নিয়ে বিবাদ করার কোনো মানে হয় না৷''
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব ধর্মের অনুষ্ঠানে অংশ নেন৷ ঈদে হিজাব পরে প্রার্থনা করেন, বড়দিনে গির্জায় যান৷ এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে৷ রেজাউল করিমের বক্তব্য, ‘‘রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এই আচরণ সঠিক নয়৷ হিজাব বা বোরখাকে মান্যতা দেয় তাঁর এই ভূমিকা৷ সব মুসলমান মহিলা কি হিজাব পরেন? তাহলে সেই পোশাক পরে মুখ্যমন্ত্রী কী প্রমাণ করতে চান? প্রশাসনের প্রধান হিসেবে তাঁর উচিত সব ধর্মের থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখা৷''