ছাত্র আন্দোলনে দুর্ঘটনার বিচারের আশা
১৩ আগস্ট ২০১৮নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের পর ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রেও আশাবাদী হয়ে উঠেছেন সাত বছর আগে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মিশুক মুনীরের ভাই আসিফ মুনীর৷
তিনি সোমবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশের যে সংস্কৃতি তাতে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে৷ এতেও আমরা খুশি৷''
২০১১ সালের এই দিনে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মাইক্রোতে বাসের ধাক্কায় নিহত হয়েছিলেন এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মিশুক মুনীর ও খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদসহ পাঁচজন৷
প্রাণহানির ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় বিচারিক আদালতেযাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বাসচালকের আপিল এখন হাই কোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে৷ এছাড়া নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে মোটরযান অধ্যাদেশের বিধান অনুসারে ক্ষতিপূরণ চেয়ে পৃথক দুটি মামলা হয়৷
এর মধ্যে তারেক মাসুদের পরিবারের করা মামলায় হাই কোর্ট ক্ষতিপূরণের রায় দিয়েছে৷ তার বিরুদ্ধে বাস মালিকপক্ষ ও বাদীপক্ষ পৃথক লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেছে, যা আপিল বিভাগে শুনানির জন্য রয়েছে৷ অপরদিকে মিশুক মুনীরের পরিবারের পক্ষ থেকে করা ক্ষতিপূরণ মামলায় হাই কোর্টে সাক্ষ্য চলছে৷
আসিফ মুনীর জানান, সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের পর তাঁদের মামলা গতি পেয়েছে৷ এখন ঘন ঘন তারিখ পড়ছে৷
একে ‘দেশে বিচার প্রক্রিয়ার শুরু' হিসেবে দেখছেন মানবাধিকারকর্মী আসিফ৷
তিনি বলেন, ‘‘এটা ভালো দিক৷ বিচারটা অন্তত হোক৷ এখন চাওয়া সামনের দিকে সবগুলো মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি৷
‘‘শুধু নিষ্পত্তি হলেই হবে না, রায় কার্যকর করাও বড় চ্যালেঞ্জ৷ এখন আমাদের চাওয়া শাস্তি যা-ই হোক, বিচারটা তো হোক৷ অন্তত এই সংস্কৃতিটা শুরু হোক৷''
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধারাবাহিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির মধ্যে গত ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় মারা যায় দুই স্কুল ছাত্র৷ এরপর বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা৷
নিরাপদ সড়কের দাবিতে টানা কয়েকদিন ঢাকা অচল করে বিক্ষোভ দেখান তারা৷ তাদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে৷
এই আন্দোলনের রেশ না কাটতেই সারা দেশে শুরু হয় বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ৷ পাশাপাশি দৈনিক জমার বদলে চালকদের নির্ধারিত মজুরিতে বাস চালাতে দেওয়ার ঘোষণা দেন মালিকরা৷
সোমবার দুপুরেও দুই ঘণ্টা রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় নাগরিক সচেতনতা ও অবৈধ যানবাহনবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালত৷ ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার অপরাধে ১৩টি মামলায় ২ হাজার ৩৮০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়৷ এর মধ্যে চালকের মাথায় হেলমেট না থাকায় সাতজন মোটরসাইকেল চালক এবং ফিটনেস না থাকায় একজন বাস চালককে কারাদণ্ড দেওয়া হয়৷
তবে এসব উদ্যোগেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি৷ আগের মতোই রাস্তায় যেখানে-সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রীদের ওঠানো ও নামানো হচ্ছে৷ বেপরোয়া গতিতেই চলছে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বাসগুলো৷ দুর্ঘটনাও ঘটেছে প্রায়ই৷ এরমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িও রক্ষা পায়নি বেপরোয়া বাসচালকের কবল থেকে৷
পথচারী ও যানবাহন চালকদের আইন মেনে সড়কে চলাচলে সচেতনতা বাড়াতে স্কাউট ও গার্লস গাইডের সদস্যদের নামানো হলেও তাদের আহ্বানে খুব একটা সাড়া মিলছে না৷
সোমবার দুপুর ২টার দিকে ফার্মগেইট এলাকায় দেখা যায়, গুলিস্তান থেকে মিরপুর যাওয়ার খাজাবাবা পরিবহনের দুটি বাস যাত্রী তোলার জন্য ধাক্কাধাক্কি করছে৷ আগেরদিনই গুলিস্তানে এই পরিবহনের বাসের চাপায় পথচারী এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে৷
এ প্রেক্ষাপটে রাজধানীর সড়কের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় গতি আনতে ট্রাফিক সপ্তাহ আরও তিন দিন বাড়িয়েছে পুলিশ৷
এত তৎপরতার পরেও কেন সুফল মিলছে না জানতে চাইলে ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এত দিনের এই কাজ দুই-একদিনে করা যাবে না৷ তবে কাজটা শুরু হয়েছে৷
‘‘এখানে পথচারীও বেশি, যানবাহনও বেশি৷ এর মধ্যে গ্রামের অশিক্ষিত মানুষও আছেন৷ তাঁরা ট্রাফিক আইন কী, তা-ই জানেন না৷ আবার যারা জানেন তাঁরা মানতে চান না৷ চালকরা কথা শুনতে চায় না৷ ফলে সড়কে একটা নৈরাজ্য আছেই৷''
সড়কে শৃঙ্খলা আনতে ট্রাফিক সপ্তাহের পর নতুন কর্মপন্থা ঠিক করে আবারও মাঠে নামা হবে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা৷
‘‘আমরা থেমে থাকব না৷ আমাদের চেষ্টা চলতেই থাকবে৷ এটা করতেই হবে,'' বলেন তিনি৷
এদিকে ঈদযাত্রা ঘিরে মহাসড়কে যাতে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল করতে না পারে সেজন্য কড়া নজরদারি থাকবে বলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারী জানিয়েছেন৷
সোমবার পুলিশ সদর দপ্তরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘মহাসড়কে যাতে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল করতে না পারে তা আমরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করব৷ মহাসড়কে যানজট নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারা রাস্তায় থাকবেন৷''
পরিস্থিতির উন্নয়নে বাসমালিকরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে দাবি করেছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা মালিকরা চেষ্টা করছি৷ নিজেরা মাঠে নেমে নিজেদের বাস ডাম্পিংয়ে পাঠাচ্ছি, সার্জেন্ট ডেকে মামলা দিচ্ছি৷ আসলে চুক্তিতে বাস চালানো বন্ধ করা গেলে দুর্ঘটনার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা কারণ অন্তত আটকানো যাবে৷''
মঙ্গলবার তিনি নিজে সহকর্মীদের নিয়ে সংসদ ভবনের সামনে থাকবেন জানিয়ে এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, তাঁদের চারটি টিমে ৬০ জন পরিবহন মালিক-শ্রমিক কাজ করছেন৷