জার্মানি ছেড়ে তুর্কি বংশোদ্ভূতরা ফিরে যাচ্ছে তুরস্কে
২৭ জানুয়ারি ২০১১পঞ্চাশ বছর আগে জার্মানি এবং তুরস্কের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল৷ সেই চুক্তি অনুসারে তুরস্ক থেকে কর্মী আনা হবে জার্মানিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য৷ এরপর তারা ফিরে যাবে তুরস্কে৷ কিন্তু অনেকেই ফিরে যায়নি বা যেতে চায়নি৷ অনেকেই রয়ে গেছেন প্রজন্ম ধরে৷ ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী সবাই জন্মেছে জার্মানিতে৷ তৃতীয় প্রজন্মের অনেকেই ইদানিং ফিরে যাচ্ছে তুরস্কে৷ কেন?
সাদেত সিমসিতের কাহিনী
সাদেত সিমসিত বয়স ৩৮ বছর৷ তিনি কাজ করেন ইস্তানবুলের একজন কসমেটিক সার্জানের সহযোগী হিসেবে৷ তিন বছর আগেও তিনি কাজ করেছেন জার্মানির বন্দর নগরী হামবুর্গে৷ এরপর তিনি চলে যান ইস্তানবুলে৷ শারীরিক বেশ কিছু পরিবর্তন তিনি এনেছেন নিজের মধ্যে৷ তিনি বললেন, ‘‘আমি আমার গাল থেকে মাংস ঝরিয়েছি৷ চোখের কোল ঠিক করেছি৷ চোখের পাপড়ি, ভুরু ঠিক করিয়েছি৷ অপারেশন করে চোখ বড় করেছি৷ ওজনটাও কমিয়েছি৷''
এসব অপারেশনের পর সাদেত নিজেকে তরুণী মনে করছেন৷ নতুন চেহারা, নতুন শারীরিক গঠনের কারণে অনেকেই ঈর্ষান্বিত চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে৷ এসব বেশ আনন্দই দিচ্ছে সাদেত সিমসিতকে৷ হামবুর্গে বেশ কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন সাদেত৷ অনেক ছোটবেলা থেকেই ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল৷ রাস্তায় একবার একজন মহিলা গান গাইছিলেন৷ সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল৷ সাদেত ও ছিল সবার মধ্যে৷ সাদেত সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, ‘‘হঠাৎ করে একজন বয়স্ক মহিলা আমার হাত খামচে ধরে৷ চিৎকার করে আমাকে বলে,‘‘অসভ্য তুর্কি, চলে যা আমাদের দেশ থেকে৷'' এরপর মহিলা আমাকে গালিগালাজ করতে থাকে৷ পুরো ঘটনাটি আমাকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দেয়৷ আমি সেখান থেকে সোজা বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম৷ আমার মা বার বার প্রশ্ন করছিলেন, কী হয়েছে? আমি ভয়ে উত্তর দিয়েছিলাম –‘কিছুই হয়নি'৷''
তিনটি প্রজন্মের পরও জার্মানি নিজের দেশ নয়
সত্তরের দশকে সাদেতের বাবা-মা তুরস্ক ছেড়ে জার্মানিতে চলে আসেন৷ তুরস্কের সঙ্গে জার্মানির যে চুক্তি হয়েছিল তার মেয়াদ ছিল ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত৷ কিন্তু তারপরও সাদেতের বাবা-মা থেকে যান জার্মানিতে৷ তুরস্কে সব কিছু ফেলে আসেন সাদেতের বাবা৷ তিনি পেশায় একজন মেকানিক ছিলেন৷ হামবুর্গে তিনি সরাসরি শিপইয়ার্ডের কাজে যোগ দেন৷ সাদেত জানান, ‘‘প্রথমত এখানে কাজ ছিল, দ্বিতীয়ত কৌতুহল৷ আমার বাবার ইস্তানবুলেই সবকিছু ছিল৷ কেন বাবা সব ছেড়ে জার্মানিতে গিয়েছিলেন তা শুধু তিনিই জানেন৷ এখানেই বাবার ওয়ার্কশপ ছিল৷ সব ছেড়ে তিনি চলে যান হামবুর্গে৷''
সাদেতের বাবা-মা এখনো জার্মানিতে বসবাস করেন এবং তাঁরা কেউই জার্মান ভাষা জানেন না৷ সাদেতের জন্ম জার্মানিতে৷ এখানেই সে পড়াশোনা করেছে৷ সে জার্মান জানে কিন্তু কাজ চালানোর মত তুর্কিও বলতে পারে৷ ইস্তানবুলে যেখানে কাজ করে সেখানে অনেক কম বেতন পাচ্ছে সাদেত৷ পোশাক-আশাকেও অনেক সংযত হতে হয়েছে সাদেতকে৷ তবে সাদেত একা নয়৷ সাদেতের মত আয়েশা কার্তনও তুর্কি বংশোদ্ভূত৷ জন্ম জার্মানিতে কিন্তু ফিরে গেছেন ইস্তানবুলে৷
চাকরির জন্য ফিরে যাওয়া ইস্তানবুলে
আয়েশা কার্তনের বয়স ৩৪৷ সে কাজ করে একটি অলঙ্কারের দোকানে৷ ২০০৯ সালে সে হামবুর্গ থেকে ইস্তানবুলে ফিরে গেছে৷ সে বলল, ‘‘এখানে যে কেউ-ই মনে করে জার্মান-তুর্কি? তার মানে অনেক টাকা-পয়সা৷ অথচ বাস্তবে একেবারেই উল্টো৷ এখানে আমি যে কাজ করি তা একেবারে সাধারণ কাজ৷ জার্মানির সঙ্গে তুলনা করলে সত্যিই অনেক কম৷ জার্মান পরিচিতি-পত্রের জন্য অনেকেই সহজে সম্পর্ক করতে চায়৷ মনে করে তাহলে হয়তো বা জার্মানি যাওয়া যাবে, অনেক টাকা-পয়সা উপার্জন করা যাবে৷ তাই আমাকে একটু সাবধান থাকতে হয়৷''
সংস্কৃতির পার্থক্য এদের কাছে ধরা পড়ছে৷ জার্মানিতে অন্ততপক্ষে সরাসরি কেউ প্রশ্ন করে না,‘‘বেতন কত?''৷ আয়েশা কিন্তু জানাল, তুরস্কে ৩৪ বছরের কেউ অবিবাহিত নেই৷ একটু বয়স হয়ে গেলে বিয়ে করতে কেউ-ই আগ্রহী হয় না৷ আয়েশাকে কেউ বিয়ের প্রস্তাব দেয় না৷ তবে কাজের জন্য আয়েশা ইস্তানবুলে এসেছেন৷ আয়েশা আরো জানায়, ‘‘একটি জার্মান কোম্পানির স্টোর ম্যানেজারের পদে আমাকে নেওয়া হয়৷ স্টোরটি ইস্তানবুলে৷ আমি সোজা চাকরিটি করতে রাজি হয়ে যাই৷''
আয়েশার মূল লক্ষ্য দ্রুত ক্যারিয়ার গড়ে তোলা, এগিয়ে যাওয়া৷ তুর্কি বংশোদ্ভূত হওয়া কারণে জার্মানিতে যা কখনোই সম্ভব হত না৷ তবে জার্মানি ছেড়ে তুরস্কে যাওয়ার জন্য এরা কেউই মন খারাপ করে না৷ কারণ চাইলেই যে কোনদিন জার্মানি ফেরা যাবে কোন বাধা ছাড়াই৷
প্রতিবেদন: মারিনা জোয়ারদার
সম্পাদনা: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়