জার্মানিতে ‘অরফ্যান ডিজিজ’ বা বিরল অসুখের চিকিৎসা
১৪ ডিসেম্বর ২০১০জার্মানিতে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ বিরল অসুখ বিসুখের শিকার৷ বিশেষজ্ঞদের মতে এই ধরনের রোগের সংখ্যা প্রায় আট হাজারের মত হবে৷ অনেক ডাক্তার ও হাসপাতাল অভিজ্ঞতার অভাবে এই সব রোগের চিকিৎসার কোনো পথ খুঁজে পাননা৷ চিকিৎসা ক্ষেত্রে এইসব রোগের নাম দেয়া হয়েছে ‘অরফ্যান ডিজিজ'৷ সম্প্রতি এই ধরনের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার উন্নতির লক্ষ্যে বার্লিনে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল৷ এতে যোগ দিয়েছিলেন চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংস্থা, স্বাস্থ্যবিমা প্রতিষ্ঠান, রোগীদের আত্মীয়স্বজন ও বিশেষজ্ঞরা৷
৫৩ বছর বয়সি মারিয়ন লেসনি সিরিয়েনোমেলিয়া রোগে আক্রান্ত৷ মেরুদণ্ডে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র হয়ে যায় বিরল এই অসুখটিতে৷ মারিয়ন জানান, ‘‘প্রথমে আমার শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে যায়৷ ১৬ বছর বয়স থেকে এই রোগের লক্ষণগুলি দেখা দেয়৷ মাত্র আড়াই বছর আগে বোঝা গেল এই অসুখটা কী? অর্থাৎ ৩৭ বছর লাগলো রোগটা ধরতে৷''
মারিয়ন লেসনির মত বহু রোগী তাঁদের রোগ নির্ণয়ের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করেন৷ অনেক চিকিৎসকই বুঝে উঠতে পারেননা, রোগটা আসলে কী? হয়তো ৪০ বছরের চিকিৎসক জীবনে মাত্র একবারই এই ব্যাধির সংস্পর্শে এসেছেন কেউ কেউ৷ জার্মানির অসনাব্রুক শহরের শিশুচিকিৎসক ডাঃ গিজব্যার্ট ফয়েগ্ট এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘কোনো কোনো অসুখকে বড় গোত্রের কোনো ব্যাধির মধ্যে ফেলা যায়না৷ রোগীদের নির্দিষ্ট কোনো অসুখের নাম বলতে না পারাটা আমাদের জন্য খুব কষ্টকর৷ এটা একটা বিরাট সমস্যা৷ এতে আমরা খুব অসহায় বোধ করি৷''
হামবুর্গ শহরের উটে কুন ডিস্টোনিয়া নামে এক ধরনের অসুখে ভুগছেন৷ জিনগত কারণে খিঁচুনি দিয়ে পেশিগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে৷ আগে ভাগে না জানিয়েই হঠাৎ দেখা দেয় রোগের লক্ষণগুলো৷ জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে হয় উটে কুনকে৷ কেননা চোখের পাতা বার বার বন্ধ হয়ে যায়৷ তাঁর ডাক্তারও ধরতে পারছেননা রোগটা৷ উটে কুন এপ্রসঙ্গে জানান, ‘‘বলা হয় এটা সাইকোসোমাটিক৷ বা মানসিক৷ দেখুন কীভাবে এই সমস্যাটা দূর করতে পারেন, তাহলে পেশির খিঁচুনিও আর থাকবেনা৷ চোখও আবার আবার খুলতে পারবেন৷'' বিরল ব্যাধি বিষয়ক সম্মেলনের জার্মানির মুখপাত্র মিরিয়াম মান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘ইউরোপের অন্যান্য দেশ এ ব্যাপারে বেশ তৎপর৷ ফ্রান্স ও ডেনমার্কে ‘অ্যালায়েন্স ফর রেয়ার ডিজিজ' রয়েছে৷ অ্যামেরিকাতেও রয়েছে এই ধরনের উদ্যোগ৷ জার্মানি এ ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে আছে৷''
বিশেষ ধরনের হাসপাতালেরও অভাব রয়েছে এখানে৷ গত ফেব্রুয়ারি মাসে ট্যুবিংগেন শহরের ইউনিভার্সিটি ক্লিনিকে চক্ষু, চর্ম ও স্নায়ুবিষয়ক বিরল অসুখ বিসুখের শাখা খোলা হয়েছে৷ বলেন প্রফেসর ডাঃ ওলাফ রিস৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমরা এখন পরের ধাপে যাচ্ছি৷ ট্যুবিংগেনে ৩০ থেকে ৪০ লাখ রোগীর চিকিৎসা করাতে পারব না আমরা৷ সারা জার্মানিতেই একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চাই আমরা৷ কোন কোন জায়গায় কোন কোন বিশেষ ধরনের রোগব্যাধি দেখা দেয়, তা খুঁজে বের করতে হবে আমাদের৷''
বার্লিনের শারিটে ক্লিনিকে এবং হানোফার শহরের মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ হাসপাতালগুলি যতটা সম্ভব বেশি রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে সচেষ্ট হচ্ছে৷ এক এক জায়গায় এক এক ধরনের রোগের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে৷ প্রফেসর ওলাফ রিস আরো জানান, ‘‘আমরা চাই, রোগীদের যেন জার্মানির বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসার খোঁজে ঘুরতে না হয়৷ বার্লিনে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, হানোফার কিংবা মিউনিখে চক্ষুবিশেষজ্ঞ খোঁজার চেয়ে আমাদের চিকিৎসা কেন্দ্রের সঙ্গে তারা প্রথমে যোগাযোগ করতে পারেন৷''
এরপরের পদক্ষেপ হবে, বিরল ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের বিশেষ বিশেষ হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা৷ অন্যান্য চিকিৎসকদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে এই উদ্যোগে৷ বার্লিনের শারিটে ক্লিনিকে এ ক্ষেত্রে একজন সমন্বয়কারী বা দিক নির্দেশকও নিযুক্ত হয়েছেন৷ চিকিৎসারত ডাক্তার ও রোগীদের তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করছেন তিনি৷ যেমন বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা ও বিশেষ ধরনের গবেষণাগারের খোঁজখবর দেয়া ইত্যাদির দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত৷ ডাঃ ক্রিস্টায়ানে মুন্ডলোজ এই রকম একজন সমন্বয়কারী৷ তিনি বলেন, ‘‘বিশেষ করে চিকিৎসক ও থেরাপিস্টদের জন্য আমি কাজ করি৷ তবে মাঝে মাঝে রোগীরাও আমার কাছে সরাসরি আসেন৷ আমি তাঁদের প্রথমে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য বলি৷ রোগীর অনুমোদন পেলে তাঁর রোগ সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত চিকিৎসক আমার কাছে পাঠাতে পারেন, যা নিয়ে আমি এব্যাপারে আরো গবেষণা করতে পারি৷''
এ ক্ষেত্রে ইন্টারনেটও একটা বড় সহযোগিতা৷ প্যারিসকেন্দ্রিক ‘অর্ফা নেট' বিশেষ করে ৩০টি ইউরোপীয় দেশের ড্যাটা সংগ্রহ করছে৷ ক্লিনিক্যাল গবেষণা, ওষুধপত্র, রোগীদের স্বসাহায্য প্রতিষ্ঠানগুলি তালিকাভুক্ত রয়েছে এতে৷ প্রায় ৫৬০০ রোগসংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যাবে এই নেটে৷ রোগ নির্ণয়ে অসুবিধা হলে চিকিৎসকরা অর্ফা নেটের সাহায্য নিতে পারেন৷ প্রফেসর মানফ্রেড শ্টুরমান অর্ফা নেটের জার্মান শাখার দায়িত্বে রয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘অনেক ডাক্তার কোনো রোগীর অসুখটা ঠিক ধরতে পারেননা৷ কিন্তু রোগের লক্ষণগুলি বুঝতে পারেন৷ এই সব লক্ষণ কোনো নির্দিষ্ট অসুখের কিনা তা বের করতে হলে ‘অর্ফা নেটে'র সাহায্য নিতে পারেন তাঁরা৷''
প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক