চাঁদাবাজদের মৃত্যু পরোয়ানার মুখে ব্যবসায়ীরা!
১৮ মে ২০১৯‘‘আমিতো প্রায় এক বছর ধরে চাঁদাবাজদের মৃত্যু পরোয়ানার মুখে আছি৷ এখন আমার পাশের ব্যবসায়ীকে টেলিফোনে মৃত্যুর হুমকি দেয়া হয়েছে৷ আমরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছি৷ পুলিশও পাহারা দেয়৷ কিন্তু তাতে কী হবে৷ তারাতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এসে হামলা করে না৷ তারা বাসার কাছে অথবা তাদের সুবিধামত জায়গায় হামলা করে৷ আর একজনকে হত্যা করে হুমকি দেয়ার সময় তাঁর উদাহরণ দেয়৷ আমরা জানিনা কে আমাদের রক্ষা করবে৷ নিরাপত্তা দেবে৷''
ঢাকার কচুক্ষেত এলাকার এক ব্যবসায়ী ডয়চে ভেলেকে এই কথা যখন বলছিলেন তখন বার বার তাঁর নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন৷ তাঁর নাম প্রকাশ হলে তাকে কোনোভাবেই ছাড়বেনা সন্ত্রাসীরা৷ আর কথা বলার সময় আরো কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং ডয়চে ভেলের প্রতিবেদকের ফোন নম্বর তাদের দিয়ে নিশ্চিত হন যে আসলেই সাংবাদিক কিনা৷ কথা বলতে গিয়ে তিনি বার বার বার কেঁপে ওঠেন৷ আর বার বার বলেন, ‘‘প্লিজ, আমার পরিচয় প্রকাশ করবেন না৷ আপনাকে বিশ্বাস করে এই কথা বলছি৷''
কচুক্ষেত ও কাফরুল এলাকার কমপক্ষে দেড়শ' ব্যবসায়ী চাঁদাবাজদের টেলিফোন হুমকির মুখে আছেন৷ জিডি করা হয়েছে কমপক্ষে ৫০টি৷ টেলিফোনে শাহিন শিকদার নাম শুনলেই তারা কেঁপে ওঠেন৷ কারণ অধিকাংশ হুমকিই দেয়া হয় শাহিন শিকদারের নামে৷ কিন্তু পুলিশ বলছে তাদের তালিকায় শাহিন শিকদার নামে কোনো সন্ত্রাসী নেই!
গত বছরের ৩১ অক্টোবর কচুক্ষেত এলাকায় চাঁদা না পেয়ে রুবেল নামে এক ব্যবসায়ীকে তাঁর বাসার কাছেই হত্যা করে সন্ত্রাসীরা৷ পুলিশ ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটজনকে আটক করে৷ কিন্তু তারপরও হুমকি থেমে নেই৷ বরং রুবেলকে হত্যার উদাহরণ দিয়ে বাকিদের হুমকি দেয়া হয়৷
রুবেলকে হত্যার ১৫ দিন আগে আরেকজন ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানকে হত্যা করা হয়৷ তার এক মাস আগে আব্দুর রহমান নামে আরেকজন ব্যবসায়ীকে হত্যার জন্য হামলা করা হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান৷
যেসব মোবাইল ফোন দিয়ে হুমকি দেয়া হয় তার ডায়ালিং কোড দেখে মনে হবে মোবাইল ফোন নম্বরগুলো বাংলাদেশের নয়৷ বিদেশ থেকে ফোন করা হয়৷ কিন্তু পুলিশ তদন্ত করে দেখেছে ওই নম্বরগুলো বাংলাদেশেরই৷ তারা সফটওয়ার ব্যবহার করে কল দেয়৷ মূল নম্বর বের করে পুলিশ কুমিল্লা থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে৷ আর শুধু কচুক্ষেত নয়৷ ঢাকার কাফরুল, মিরপুর এবং ইব্রাহীমপুর এলাকার ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি হুমকি পাচ্ছেন৷ ওই এলাকার লেপ-তোশক থেকে শুরু করে সাধারণ ফলের দোকানদারও হুমকি থেকে বাদ যাচ্ছেন না৷ আর চাঁদা দাবি করা হচ্ছে এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা৷ কচুক্ষেতে নিহত ব্যবসায়ী রুবেলের কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছিল৷ তিনি চাঁদা দিতে অস্বীকার করে সরাসরি পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছিলেন৷ থানায় জিডি করেছিলেন৷ তারপরও তিনি বাঁচতে পারেননি৷
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অপরাধীরা ঢাকায় বসেই বিদেশি মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করে বলে আমরা প্রমাণ পেয়েছি৷ তারা বাইরের মোবাইল ফোন নম্বর রোমিং করে বাংলাদেশে বসে ব্যবহার করেন৷ আমরা যুক্তরাষ্ট্র, সিংগাপুর ও ভারতের মোবাইল ফোন নম্বর বাংলাদেশে ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছি৷''
তিনি বলেন, ‘‘আবার দেশের বাইরে বসে কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ঢাকায় তাদের সন্ত্রাসী গ্রুপ পরিচালনা করে৷ তারা সিংগাপুর, ভারত ও কানাডায় অবস্থান করছে৷ তারা দেশের বাইরে থাকলে ঢাকায় তাদের অনুসারী গ্রুপ আছে৷ তারাও চাঁদার জন্য হুমকি দেয়৷ তবে অনেক সময় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামও ব্যবহার করা হয়৷''
প্রসঙ্গত, গত বছরের অক্টোবরে একমাসে মিরপুরে চাঁদাবাজদের হাতে নিহত হন তিনজন৷ তাদের মধ্যে দু'জন ব্যবসায়ী৷ আর আরেকজন চাঁদাবাজদের ভুল টার্গেটের শিকার হয়েছেন চেহারার মিল থাকায়৷ কাফরুলের মিজানুর রহমান হত্যার ঘটনায় পুলিশ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে৷ তাদের মধ্যে মিশু নামের একজন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে৷ সে জবানবন্দিতে জানিয়েছে, ‘‘চাঁদার অঙ্ক বাড়াতে লাশ ফেলে টার্গেট করা অন্যদের কাছে বার্তা পাঠায় তারা৷ হত্যার পরপরই অন্যদের ফোন করে বলা হয়, চাঁদা দে, নইলে একই পরিণতির শিকার হতে হবে৷'' আর তারা হত্যাকাণ্ডে এখন আগ্নেয়াস্ত্রের পরিবর্তে নাইন গিয়ারের চাকু ব্যবহার করে৷ এর কারণ হিসেব তারা নিজেদের নিরাপত্তা এবং নৃশংসতার মাধ্যমে ভীতি সৃষ্টির কথা জানায়৷ ব্যবসায়ী রুবেলকেও চাকু মেরে হত্যা করা হয়৷
ওইসব এলাকার হুমকি পাওয়া ব্যবসায়ীরা এখন ভয়ে তাদের ফোন বন্ধ রাখেন৷ আর কেউ জানতে চাইলে তারা প্রকাশ করতে সাহস করেননা৷ এমনকি পুলিশকে এড়িয়ে কেউ কেউ চাঁদা দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করেন৷ কারণ হুমকির কথা প্রকাশ হলে সন্ত্রাসীরা আরো বেপরোয়া হয়ে যায়৷ দোকানে পুলিশ এলে জানাজানি হয়, ব্যবসার ক্ষতি হয়৷ সবাই তার দোকান এড়িয়ে চলে৷ ক্রেতারা আসেনা৷ একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘ছয় মাস আমার দোকানের সামনে যখন পুলিশ পাহারা ছিলো, তখন আমি কোনো ব্যবসা করতে পারিনি৷ কোনো ক্রেতা আসতোনা৷ এমনকি বন্ধু বান্ধবও আসতোনা৷''
ইংরেজি দৈনিক ‘‘দ্য ডেইলি স্টারের'' অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিক শাহীন মোল্লা কচুক্ষেত ও কাফরুল এলাকায় এই চাঁদাবাজীর হুমকি এবং হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরেজমিন কাজ করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘গত বছর কমপক্ষে ৬০ জন ব্যবসায়ী হুমকি পাওয়ার পর থানায় জিডি করেছেন৷ কিন্তু তেমন প্রতিকার পাননি৷ এখন ব্যবসায়ীরা জিডি করাও ছেড়ে দিয়েছেন৷ তারা যে যেভাবে পারছেন নিজেদেরর রক্ষা করার চেষ্টা করছেন৷ কোনো কোনো ব্যবসায়ী একবার চাঁদা দেয়ার পর তার কাছে আবার দ্বিতীয়বার চাঁদা দাবি করা হচ্ছে৷ আর নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুললেই চাঁদাবাজরা তাদের টার্গেট করে৷ তারা খুবই আতঙ্কে আছেন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘শুধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, ওই এলাকার নতুন ভবন নির্মাণ, পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসায়ীদের চাঁদাবাজরা অর্থের জন্য হুমকি দেয়৷''
তবে, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছি ঐক্যবদ্ধভাবে৷ ফলে তাদের দৌরাত্ম কমে এসেছে৷ কাফরুল, কচুক্ষেত ও মিরপুরের ঘটনা আমার জানা নেই৷ তাদের উচিত ছিলো আমাদেরকে জানানো৷ ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তহীনতা কোনোভাবেই কাম্য নয়৷''
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নিই৷ যে মাধ্যমেই হুমকি দেয়া হোক না কেন আমরা সেই মাধ্যমেই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব৷ এখন প্রযুক্তি অনেক উন্নত৷ যারা হুমকি দেয়, তাদের চিহ্নিত করা কোনো কঠিন কাজ নয়৷ তারা যেন লিখিত অভিযোগ করেন৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা এখন অনেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে৷ ফলে যেসব ফোন নম্বর দেখে বিদেশি মনে হয় তার অধিকাংশ ফোন নম্বরই দেশি৷ আমরা তদন্ত করে দেখেছি দেশে বা বিদেশ থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে যে হুমকি দেয়া হয় তা আসলে ভুয়া৷ এখানকার সন্ত্রাসীরাই তাদের নাম ব্যবহার করে৷''
আর মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের উপ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘‘চাঁদাবাজদের টেলিফোন হুমকি আগে অনেক বেশি ছিলো৷ এখন তা অনেক কমে এসেছে৷ আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি৷ কয়েকটি গ্রুপকে আটকও করেছি৷''