চট্টগ্রাম – জাহাজের কবরস্থান
প্রতিবছর এক হাজারের বেশি জাহাজ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়৷ এগুলোর অধিকাংশের শেষ ঠিকানা তখন হয় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে৷ এই কাজ অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং প্রাণঘাতী৷
শান্তিতে থাকুক?
চট্টগ্রামে কয়েক ডজন শিপব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে৷ দুই লাখের মতো শ্রমিক হাজার কোটি টাকার এই বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ বড় বড় জাহাজ টুকরা টুকরা করার কাজ অধিকাংশক্ষেত্রে করে খালি হাতে৷ তাই শারীরিক ক্ষতি এমনকি মৃত্যু সেখানে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়৷
আলমগীর – জাহাজের কবর খোঁড়েন যিনি
ডয়চে ভেলের লাইফ লিংকস অনুষ্ঠানের ‘#হেডএবাভওয়াটার’ পর্বের জন্য আমরা আলমগীরের সঙ্গে দেখা করতে চট্টগ্রাম যাই৷ সে দিনে ১৪ ঘণ্টার মতো কাজ করে৷ মজুরিও অনেক কম৷
টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়
একটি মালবাহী শিপ গড়ে ২৫ থেকে ৩০ বছর ব্যবহার করা যায়৷ এরপর সেটার ইন্সুরেন্স এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এত বেড়ে যায় যে সেটি ব্যবহার আর লাভজনক থাকে না৷ ফলে অধিকাংশ জাহাজ তখন চলে যায় বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে৷ এ সব ইয়ার্ডে মূলত অদক্ষ শ্রমিকরা জাহাজ ভাঙার কাজ করে৷
বিপজ্জনক বিনাশ
একটি জাহাজের ভেতরের অংশ প্রথমে ভাঙা হয়৷ কাজটি অত্যন্ত কঠিন এবং বিপজ্জনক৷ কেননা জাহাজ তৈরি করা হয় এমনভাবে, যাতে সেটা প্রতিকূল আবহাওয়ার মোকাবিলা করতে পারে এবং ভেঙে না যায়৷ তাই সেই জাহাজ কার্যত খালি হাতে ভাঙতে গিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার শঙ্কায় থাকেন শ্রমিকরা৷
ধীরে ধীরে মৃত্যু
অধিকাংশ শ্রমিককে কাজ করার সময় ‘প্রটেকটিভ গিয়ার’ দেয়া হয়না৷ তারা জাহাজ ভাঙেন খালি হাতে ‘এসেটিলিন টর্চ’ ব্যবহার করেন৷ অদক্ষ এই শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা বা বিস্ফোরণে আহত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন৷
বিপজ্জনক অবস্থা
জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকরা কাজ করার সময় বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে আসেন যা ফুসফুসে সমস্যা, এমনকি ক্যানসারেরও কারণ হতে পারে৷ আরা যাঁরা কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে না ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ৷ এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় না৷
স্টিলের উৎস
বেসরকারি উন্নয়নসংস্থা শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দু’শ-র মতো জাহাজ চট্টগ্রামে ভাঙা হয়৷ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে স্টিলের যে চাহিদা রয়েছে, তার অধিকাংশই জোগাড় হয় জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে৷ চট্টগ্রামের উত্তরে সীতাকুণ্ড হচ্ছে এই শিল্পের রাজধানী৷ সেখানে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সৈকতে আট মাইল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে এই শিল্প৷
১৯৬৯ সালে শুরু
চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শুরু হয় ১৯৬৯ সালের দিকে৷ একটি স্টিল কোম্পানি সেসময় একটি অকেজো জাহাজ সেখানে নিয়ে যায় এবং ভাঙতে শুরু করে৷ কয়েক বছর লেগেছিল সেটি ভাঙতে৷ চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শিল্পের শুরুটা এভাবেই৷
শিশুরাও কাজ করছে
জাহাজ ভাঙা শিল্পে শিশুশ্রম সাধারণ ব্যাপার৷ বাংলাদেশের মোট কর্মশক্তির এক পঞ্চমাংশের বয়স ১৫ বছরের নীচে৷ ধারণা করা হয় জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের অর্ধেকের বয়স ২২ বছরের নীচে৷ অল্প বয়সি শিশুরা গ্যাস কাটারদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে এবং মালামাল বহন করে৷ এসব শিশু লেখাপড়ার সুযোগ পাওয়া না এবং বিরূপ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হয়৷
পণ্য বিক্রি
জাহাজের মধ্যে পাওয়া বিভিন্ন পণ্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেন শ্রমিকরা৷ এ সবের মধ্যে আসবাবপত্র এবং ‘শো পিস’ ছাড়াও রয়েছে মালিকদের জাহাজে ফেলে যাওয়া বিভিন্ন সামগ্রী৷
দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ
সীতাকুণ্ডের সমুদ্র সৈকত একসময় পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক স্থান ছিল৷ কিন্তু এখন জাহাজ ভাঙা শিল্পের কারণে সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ৷ শিপিং ইয়ার্ড থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে৷ বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে বেশ উদাসীন৷