চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ফিশারি ঘাট
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক এবং মিঠা পানির মাছের পাইকারি বাজার৷ নাম ফিশারি ঘাট৷
সমুদ্র থেকে সরাসরি ঘাটে
প্রায় ২০০ বছর আগে ফিরিঙ্গি বাজারে এই ঘাটের গোড়াপত্তন ঘটান পর্তুগিজরা৷ মৌসুমভেদে দৈনিক ৫ থেকে ৫০ কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয় এই ঘাটে৷ কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে ওঠায় মাছ ধরার ট্রলারগুলো সমুদ্র থেকে সহজেই এই ঘাটে ভিড়তে পারে৷ এখানে সকাল-বিকাল দুইবার জোয়ার-ভাটা হয়৷ জোয়ারের সময় পানি বেড়ে গেলে ট্রলারগুলো ঘাটে প্রবেশ করে এবং বের হয়ে যায়৷
রকেট মাছ
ফিশারি ঘাটের নিয়মিত একজন মাছ বিক্রেতা সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সাগ্রহে একটি বড় মাছ দেখিয়ে বলেন, ‘‘স্যার, এই মাছ দেখতে রকেটের মতো, নামও রকেট সুরমা৷’’ পরে জানা গেল, এই মাছ সাধারণত ২ থেকে ১২ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে৷ প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৩৫০ টাকা দরে৷
নিলামে মাছ বিক্রি
ফিশারি ঘাটের অন্যতম আকর্ষণ ইলিশ মাছ৷ ট্রাকে করে বড়, মাঝারি এবং ছোট, এই তিন আকারের মাছ আসার পর ব্যাপারীরা নিলাম ডাকেন৷ এক্ষেত্রে যিনি সবচেয়ে বেশি দাম হাঁকেন, তিনি পুরো ট্রাক মাছের মালিক হয়ে যান৷ একেকটি মাঝারি সাইজের ট্রাকে ৩০-৩৫ মণ ইলিশ মাছ থাকে৷
টেনেটুনে হাত খরচের টাকা হয়
এই ঘাটে দেড় বছর ধরে কাজ করে রফিক উদ্দিন৷ তিনি জানান, রাত তিনটা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত কাজ করে যে টাকা উপার্জন হয়, সেখান থেকে নিজের হাতখরচের সামান্য কিছু টাকা রেখে বাকিটা পরিবারে দিয়ে দেন৷
প্যাকেট অক্সিজেন
মাছ কেনা শেষ, এখন সেটি নিজ এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাবেন একজন খুচরা মাছ ব্যবসায়ী৷ প্যাকেট থেকে সাদা গুঁড়াজাতীয় কী দিচ্ছেন জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল, এটি অক্সিজেন৷ এটি পানিতে দিলে সাধারণত তিন ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত মাছ জীবিত থাকে৷
যেন মাছের খনি
ফিশারি ঘাটের মাছের নাম বলে শেষ করা কঠিন৷ এদের মধ্যে মিঠা পানির মাছ হচ্ছে রুই, কাতলা, মাগুর, শিং, কই, তেলাপিয়া, বাইম, পুঁটি আর সামুদ্রিক মাছের মধ্যে চিংড়ি, ইলিশ, কোরাল, ভেটকি, রূপচাঁদা, টুনা, স্যামন, স্কুইড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য৷
বিক্রিত মাছ যায় সারাদেশে
৩০ বছর ধরে মাছের ব্যবসা করেন এমন একজন ব্যাপারী জানালেন, সম্ভবত দেশের এমন কোনো জেলা নেই যেখান থেকে এখানে মাছ আসে না এবং এখানকার মাছ যায় না৷ যারা নিয়মিত দূর থেকে আসেন, ভোগান্তি এড়াতে তাঁরা আগে থেকেই নিজস্ব পরিবহন ভাড়া করে নিয়ে আসেন৷
‘‘আব্বার মাইরের ভয়ে এহানে কাম করি’’
করোনাকালীন সময়ে মোবারকের বাবার রোজগার ভালো যাচ্ছে না, তাই তিনি পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যকেও কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন৷ তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া মোবারক জানায়, এখানে কাজ করতে তার ভালো লাগে না৷ কিন্তু না আসলে তার বাবা মারতে পারে, তাই এখানে আসে সে৷ এখানে দৈনিক আয় হয় ১৫০ টাকার মতো৷
ব্যবসা চলে বাকিতে
বেচা বিক্রি শেষ, আড়তের সামনে বসে হিসাবনিকাশ করছেন একজন ম্যানেজার৷ আজকে কত টাকার মাছ বিক্রি করেছেন সে উত্তর সরাসরি না দিলেও তিনি জানালেন, মূলত এখানে ব্যবসা চলে বাকিতে৷ বাকি না দিলে ব্যবসা করা সম্ভব না৷ হতাশার সুরে তিনি বলেন, বাকির টাকা প্রায়ই লোকজন দেয় না৷ কিছুদিন আগেই এক ব্যবসায়ী ৭০ লক্ষ টাকা বাকি পরিশোধ না করেই পালিয়েছে৷
বরফের এত দাম!
যেখানে মাছের কেনাবেচা আছে, সেখানে বরফ থাকবেই৷ বরফকলে ২০-২৫ কেজি ওজনের একেকটি বরফের টুকরা সাধারণত ৬০০-৭০০ টাকায় বিক্রি হয়৷ তবে মাছের দামের সাথে বরফের দামও ওঠানামা করে৷ মাছের দাম বেশি থাকলে তখন এটি ১,৫০০ টাকায়ও বিক্রি হতে দেখা যায়৷
মাছ ধরার জাল মেরামত
ফিশারি ঘাটেই ২-৩ জায়গায় বিভিন্ন বয়সের ২০-৩০ জন মানুষকে মাছ ধরার জাল মেরামত করতে দেখা গেল৷ এটি তাঁদের নৈমিত্তিক কাজ৷ ভোর ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত জাল মেরামত করে সাধারণত জনপ্রতি তারা ৬০০ টাকা পান৷
আছে মাছ কাটার ব্যবস্থা
ফিশারি ঘাটে কয়েকজনকে পেশাদারভাবে মাছ কাটতে দেখা গেল৷ কথা বলে জানা গেল, মাছের দামের সাথে তাদের পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয়৷ বড় মাছ তারা কেজিপ্রতি ১৫-২০ টাকা নিয়ে থাকেন৷ তবে মোটামুটি ওজন ৪-৫ কেজির কম হলে মাছ কাটেন না তারা৷
আছে নদী দখলের অভিযোগ
স্থানীয় কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, তিন বছর আগে কর্ণফুলীর রাজাখালির মুখে স্থানান্তরিত হওয়া এই ফিশারি ঘাটটি নদীর জায়গা ছিল৷ নদীর তীরে মাটি ভরাট করে এটি বসানো হয়েছে৷ তবে এর পেছনে কারা জড়িত, সেসব প্রভাবশালীদের নাম বলতে অপারগতা প্রকাশ করলেন তাঁরা৷