ঘানা: দাসত্বের চারশ বছর
১৬১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছায় আফ্রিকার দাসদের প্রথম চালান৷ ২০১৯ সালে সেই নির্মম ইতিহাসের ৪০০ বছর স্মরণ করেছে ঘানা৷ ‘ফিরে আসার দিন’ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে প্রবাসী আফ্রিকানদের নিজে দেশে ফিরে আসার উৎসাহ যোগাতে চায় ঘানা৷
স্মরণে পূর্বসূরীরা
আব্দুল সুমুদ শাইবুর বয়স এখন ৫০৷ নিজের স্মার্টফোন বের করে দেখালেন পিতামহের ছবি৷ বললেন, ‘‘তাঁর উচ্চতা দেখেন!’’ তিনি আরো জানান, ‘‘আমার পূর্বসূরীরা ছিলেন অতিকায়, শক্তিশালী এবং সুঠাম দেহী৷’’ শাইবুর কথায় জানা গেল, দাসত্ব ঠেকাতে পূর্বসূরীদের অনেকেই যুদ্ধ করতেন৷ মাঝে মাঝে জয় পেতেন, কিন্তু হেরেও যেতেন৷ আর হেরে যাওয়া মানে আজীবন দাসত্ব৷
পর্তুগালের পথে
যুক্তরাষ্ট্রে দাস বিক্রির আগে থেকেই পশ্চিম আফ্রিকায় এই বাণিজ্যের প্রচলন ছিল৷ ১৫ শতকের শেষের দিকে, জাহাজে করে নিজ দেশে দাস নিয়ে যেত পর্তুগিজরা৷ ইউরোপীয় দখলদারিত্বের পর আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল হয়ে ওঠে দাস রপ্তানির মূল কেন্দ্র৷
ট্রান্সঅ্যাটলান্টিক ত্রিভূজ বাণিজ্য
দাস ব্যবসার জন্য ইউরোপের ক্ষমতাশালীরা অস্ত্র, টেক্সটাইল বা অ্যালকোহলের জাতীয় পণ্যগুলো আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে নিয়ে আসতো৷ আফ্রিকা থেকে জাহাজগুলো পাল তুলতো অ্যামেরিকার পথে৷ সেখানে চা, কফি বা সুতির মতো লোভনীয় কাঁচামালের বিপরীতে ক্রীতদাসদের বিনিময় করা হতো। আর পণ্যগুলো পাঠানো হতো ইউরোপে৷ তাই পুরো সিস্টেমটিকে বলা হতো ত্রিভুজাকার বাণিজ্য৷
নিষ্ঠুর সে পথ
ক্রীতদাসদের নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার যাত্রা ছিলো খুবই অমানবিক৷ দাসবাহী জাহাজগুলোর শেষ সেন্টিমিটার জায়গাটিও ছাড় দেয়া হতো না৷ আক্ষরিক অর্থে একে অপরের উপরে সারিবদ্ধভাবে রাখা হতো দাসদের৷ বেধে রাখা হতো শিকলে৷ দেওয়া হতো না পর্যাপ্ত খাবার বা পানি৷ আর ক্রীতদাসদের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে তাঁদের জাহাজ হতে ফেলে দেয়া হতো৷
মাঠের কাজ
‘নতুন বিশ্বে’ ক্রীতদাসদের সুতা আর আখ চাষে বাধ্য করা হতো৷ জমির মালিক লাভবান হতেন, আর ক্রীতদাস গরীবই থেকে যেতেন৷ তাঁদের জীবন যাপনও ছিলো মানবেতর৷ শহরের দিকে তাঁদেরকে দিয়ে পণ্য উঠা নামানোর কাজ করানো হত, আর গৃহস্থালি কাজে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের চলতে হতো মালিকের কথা মতো৷ অনেককে আবারো শিল্প-কারখানার কাজে লাগানো হতো৷
পরাধীন জীবন
অনেক দাসের জন্য সহিংসতা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা৷ শেকল আর লোহা দিয়ে তাঁদের চিহ্নিত করা হতো৷ কেউ আপত্তি করলেই বেত্রাঘাত৷ এমনকি, ক্রীতদাসরা কোনো সম্পর্কে জড়াবে কি-না সেই সিদ্ধান্তও নিতে পারতো তাঁদের কথিত মালিকরা৷ দাসদের কোনো অধিকার ছিল না৷ একদিন মুক্ত হবেন এই আশাটা ছিলো তাঁদের একমাত্র সম্বল৷ দাসপ্রথার স্মারক হয়ে এই শেকলটি আইভরি কোস্টের একটি যাদুঘরে রাখা আছে৷
দাসত্বের জীবন
ট্রান্সঅ্যাটলান্টিক দাস ব্যবসার সুবর্ণ সময় ছিলো ১৮ শতকে৷ আফ্রিকার দুই-তৃতীয়াংশ দাসকে নিয়ে যায় অ্যামেরিকা৷ মানচিত্রটি সেই সাক্ষ্য বহন করছে৷ এই পথ ধরে নোঙ্গর তুলে চলে যেতো দাসবাহী জাহাজ৷ কতোজন আফ্রিকান দাসত্ব বরণ করেছিলেন তার প্রকৃত সংখ্যা নেই৷ অনুমান করা হয় সংখ্যাটি অন্তত চার কোটি৷
জার্মান দাস ব্যবসায়ী
আজকের ঘানা উপকূলে ‘গ্রো ফ্রেড্রিশবুর্গ’ উপনিবেশ ছিলো ব্র্যান্ডেনবুর্গের ইলেক্টর ফ্রেডরিখ ভিলহেলমের৷ দাস ব্যবসায়ের সময় ঘানাকে ‘সোনালী উপকূল’ বলা হত৷ সেখান থেকে ব্র্যান্ডেনবুর্গাররা ত্রিভুজাকার বাণিজ্যে অংশ নিত৷
শ্রদ্ধাঞ্জলি
ঘানার আশান্তি অঞ্চলের গ্রাম আদিওয়ান৷ পূর্বসূরী কোয়ামে বাদুর সমাধিতে গিয়েছিলেন নানা অ্যাসেনসো। অনেক বছর আগে দাস হিসাবে বিক্রি করা হয় কোয়ামে বাদুকে। পূর্বপুরুষের সম্মানে তাঁদের পরিবারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে এই নামটি চলে আসছে। এমনকি, নানা অ্যাসেনসোর সন্তানের নামও কোয়ামে বাদু৷
নুহালেনিয়া আদা স্মৃতিসৌধ
নুহালেনিয়া আদা গ্রামে ইনস্টলেশন আর্টের মধ্য দিয়ে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করেন ঘানার শিল্পী কাওমে অকোটো বামফো। ১৮০৮ সালে দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশরা৷ নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ১৮১৫ সালে নিশ্চিত করে ভিয়েনার কংগ্রেস৷ তারপরেও ১৮৭০ সালের আগ পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে বিলুপ্ত হয়নি দাস প্রথা৷ ঘানার উপকূলে দাস দুর্গের ধ্বংসাবশেষ সেই যুগের স্মারক হয়ে আছে৷