গ্যোটে পদক
২০ মে ২০১৩বই-পড়ুয়ারা সরাসরি তাঁকে যদি না-ও চিনতে পারেন, তাঁর প্রকাশনা সংস্থাটিকে সবাই এক ডাকে চেনেন৷ সিগাল বুকস৷ গত চার দশক ধরে কলকাতা কেন্দ্রীক এই ইংরেজি প্রকাশনা সংস্থার সুবাদেই ধ্রুপদী এবং আধুনিক ইওরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে পাঠকসমাজের৷ পাশ্চাত্ত্য মননের সঙ্গে এক ধরনের বিনিময় সম্পর্ক যে গড়ে উঠেছে এই উপমহাদেশের সাহিত্য রসিকদের, সেটাও অংশত সিগাল বুকস-এর ধারাবাহিক প্রকাশনার কারণেই৷ নবীন কিশোর হলেন সেই সিগাল বুকস-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক, যিনি ২০১৩ সালের গ্যোটে পদক পাচ্ছেন৷
গ্যোটে ইনস্টিটিউট, অর্থাৎ জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বা মাক্স ম্যুলার ভবন জার্মানির এই সরকারি খেতাবটির জন্য প্রতি বছর এক বা একাধিক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে নির্বাচিত করে, যাঁরা বিদেশে জার্মান ভাষার প্রসার এবং আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন৷ জার্মান মহাকবি গ্যোটের নামাঙ্কিত এই পদক দেওয়া হয় প্রাপকদের৷ এ বছর সেই গ্যোটে পদক পাচ্ছেন ইরানের লেখক-অনুবাদক মাহমুদ হোসেইনি, গ্রিক লেখক পেট্রস মা মোভাক এবং কলকাতার প্রকাশক নবীন কিশোর৷
কলকাতায় শুরু হলেও নবীন কিশোরের সিগাল বুকসের শাখা কার্যালয় আছে নিউ ইয়র্ক এবং লন্ডনে৷ বিদেশে সিগাল বুকসের বইপত্রের বিপণনের দায়িত্বে আছে ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো প্রেস৷ জার্মান, ফরাসি এবং সুইস সাহিত্য সহ ইওরোপীয় সাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য অংশের আন্তর্জাতিক প্রকাশনসত্ত্ব রয়েছে সিগাল বুকসের হাতে৷ সাত বছর আগে গ্যোটে ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে শুরু হয়েছে সিগালের জার্মান লিস্ট, যা আসলে বাছাই করা জার্মান সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ৷ এর মধ্যে আছে ব্রিগিটে রাইমান এবং রাল্ফ রোঠমান-এর মতো সাহিত্যিকের লেখা, যা আগে কখনও ইংরেজিতে অনুদিত হয়নি৷ গত সাত বছরে ৬০টিরও বেশি জার্মান রচনার প্রকাশনা সত্ত্ব নিজেদের হাতে নিয়েছে সিগাল বুকস৷
সিগাল বুকস কলকাতায় তাদের শুরুটা করেছিল বাংলা থিয়েটারের স্ক্রিপ্ট-এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে৷ উৎপল দত্তের নাটক থেকে শুরু করে বাদল সরকারের অন্য ধারার থিয়েটারের স্ক্রিপ্ট, সেখান থেকে সিনেমার চিত্রনাট্য – জনপ্রিয়তার নিরাপদ আকাশে কিন্তু উড়তে শুরু করেনি নবীন কিশোরের সিগাল৷ জার্মান সাহিত্য অনুবাদের দিকে যে তাঁরা হাত বাড়িয়েছিলেন, সেটাও কি নাটক দিয়েই শুরু হয়েছিল? ডয়চে ভেলের প্রশ্নের জবাবে নবীন কিশোর জানালেন, সেটা খুবই স্বাভাবিক হতো যেহেতু ব্যার্টল্ট ব্রেশট তখনই বাঙালির অতি পরিচিত জার্মান নাট্যকার৷ কিন্তু তারও আগে থেকে, শুধু জার্মান সাহিত্য নয়, বরং সামগ্রিকভাবে ইওরোপীয় সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতিরই প্রসার ঘটানোর একটা চেষ্টা এদেশে করে আসছিল সিগাল৷ জার্মান, ফরাসি, ইটালীয়, নানা ধরনের, নানা স্বাদের সাহিত্যভাষার অনুবাদের কথা তখন থেকেই মাথায় আসে৷
নবীন কিশোর নিজে প্রকাশন সংস্থার কর্নধার হয়েও অনুবাদের আগে সমস্ত সাহিত্য তার মূল ভাষায় পড়েন না৷ তা হলে তিনি কী করে সিদ্ধান্ত নেন কোনটা অনুবাদের উপযুক্ত? অনেকেই তাঁকে এই প্রশ্ন করেন৷ নবীন কিশোর জানালেন, দুনিয়ার বিখ্যাত অনুবাদকরা সিগাল বুকসের হয়ে অনুবাদের কাজ করেন৷ তাঁদের কাছে সিগাল বুকস জানতে চায়, ওঁরা কী ধরনের কাজ করতে আগ্রহী৷ বিদেশি ভাষায়, জার্মানে, কিংবা ফরাসিতে নতুন কী লেখা বেরিয়েছে? কোনটা পড়তে তাঁদের ভালো লেগেছে? এর ফলে দুটো ঘটনা ঘটে৷ এক, অনুবাদকরা কাজ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন৷ দুই, সমসাময়িক ইওরোপীয় সাহিত্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়৷
কিন্তু একজন আন্তর্জাতিক প্রকাশক হিসেবে নবীন কিশোরের কখনও মনে হয় কি যে বাংলা ভাষার সাহিত্য-পাঠকরা বিদেশি সাহিত্যের রস থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যেহেতু ইংরেজিতে যত বেশি বিদেশি সাহিত্য অনুবাদ হয়, বাংলায় তার কিছুমাত্র হয় না? হ্যাঁ, এটা ঠিক যে বাংলায় অনুবাদ কম হয়, কথাটা মানলেন নবীন কিশোর৷ জানালেন, সিগাল বুকস কিছু কিছু চেষ্টা করছে৷ কিন্তু প্রকাশকদের আরও বেশি করে আগ্রহী হতে হবে৷ বইয়ের ব্যবসায় যত না, সাহিত্যের প্রসারে তার থেকে বেশি যত্নবান হতে হবে৷ একটা অনুবাদ সাহিত্য ছাপা হলে, যতক্ষণ না সেটা বিক্রি হয়ে টাকাটা উঠে আসছে, পরের বইয়ের কাজে হাত দেব না, এই মানসিকতা বদলাতে হবে৷ অনুবাদ সাহিত্য প্রকাশনার ধারাবাহিকতা তৈরি করতে হবে৷ বললেন নবীন কিশোর৷ চার দশক আগে ঠিক যেভাবে শুরু করেছিল সিগাল বুকস৷ গ্যোয়টে পদক সেই কাজের একটা স্বীকৃতি তো বটেই৷ যদিও অপ্রত্যাশিত এই পুরস্কার প্রাপ্তি, কিন্তু সেই কারণেই আরও বেশি আনন্দদায়ক৷